সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে এখন চলছে নতুন বিচারপতি নিয়োগের তোড়জোড়। বিচারপতি স্বল্পতার প্রেক্ষিতে শিগগিরই নিয়োগ দেয়া হবে নতুন বিচারপতি। এ লক্ষ্যে ‘নিয়োগযোগ্য’ ব্যক্তিদের বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন এখন বিবেচনার টেবিলে। কার নাম আছে ওই তালিকায়? বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তা নাকি আইনজীবী-এ প্রশ্নে বিচারাঙ্গনে চলছে বিচার-বিশ্লেষণ।
রোববার (১৬ জানুয়ারি) সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ এবং আইন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে এ তথ্য। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে প্রেসিডেন্ট হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করবেন। বিচারপতি নিয়োগের ‘যোগ্যতা’র বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট। তবে ‘অযোগ্যতা’র বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে সংবিধানে।
সংবিধানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি (২) বাংলাদেশের নাগরিক না হলে (ক) সুপ্রিম কোর্টে অন্যূন দশ বছর অ্যাডভোকেট না থাকলে অথবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন দশ বৎসর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে অথবা (গ) সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থেকে থাকলে তিনি বিচারকপদে নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না। সংবিধানের ৯৬(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিচারপতি সাতষট্টি বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে এখনো নিয়োগবিধি ও নীতিমালা প্রণীত হয়নি। প্রেসিডেন্ট এখন পর্যন্ত বিচারপতি নিয়োগ দিচ্ছেন সংবিধানের আলোকে। উচ্চ আদালতে কতজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে-তা প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার অধীন। নিয়োগের বিধান না থাকলেও ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি আপিল বিভাগ এক রায়ে বিচারপতি নিয়োগে প্রথমবারের মতো একটি গাইডলাইন দেন।
নিয়োগপ্রশ্নে এতে বলা হয় ‘প্রেসিডেন্ট প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নেবেন এবং তারা পরস্পর চিঠিপত্রের মাধ্যমে বা টেবিলে বসে পরামর্শ করতে পারেন। কিন্তু এই শলাপরামর্শের প্রতিক্রিয়াকে অধিকতর স্বচ্ছ করতে তাদের মধ্যকার আলাপ-আলোচনার রেকর্ড রাখতে হবে, যাতে বিরোধ বা মতানৈক্য দেখা দিলে কোনো দ্ব্যর্থকতা ছাড়াই তা নিরসন করা যায়।’
কিন্তু এই গাইডলাইনের পরও কয়েক দফা বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়। এতে ওই গাইডলাইন অনুসৃত না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বরং সংবিধানের উল্লেখিত অনুচ্ছেদ অনুসারেই নিয়োগ দেয়া হয় বিচারপতি। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, নীতিমালা না করে এভাবে বিচারক নিয়োগ দেয়া যথার্থ নয়।
বিধিমালা হচ্ছে-হবে মর্মে আইনমন্ত্রী সময়ক্ষেপণ করছেন। সদিচ্ছা থাকলে যেকোনো দিন বিধান করা যেতে পারে। এখানে শূন্যতার সুযোগটি রেখে দিয়ে ‘পছন্দসই’ ব্যক্তিদের বিচারপতি নিয়োগের ধারাটি অক্ষুণœ রাখা হচ্ছে। এতে বিচারবিভাগের কোয়ালিটি ঠিক থাকে না।
এদিকে সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, সংবিধানের বিধানের ভিত্তিতেই উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। একসময় উভয় বিভাগ মিলিয়ে বিচারপতি সংখ্যা উন্নীত হয়েছিল ৯৯ জনে। এ সংখ্যা এখন ৯৬ এ নেমেছে। এর মধ্যে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগে বিচারপতি রয়েছেন ৭ জন। হাইকোর্ট বিভাগে স্থায়ী বিচারপতি রয়েছেন ৮৬ জন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কর্মরত রয়েছেন ৩ জন বিচারপতি। এ অবস্থায় দুই দফায় অন্তত: এক ডজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ১৭ জন বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন জুডিশিয়াল সার্ভিস (জেলা জজ) থেকে। ৬৯ জন বিচারপতিই নিয়োগ দেয়া হয়েছে আইনজীবীদের মধ্য থেকে। অর্থাৎ জুডিশিয়াল সার্ভিসের ৬ গুণ বেশি বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে আইনজীবীদের মধ্য থেকে।
উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগে ২০ বছরের ধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট বারে প্র্যাক্টিসরত আইনজীবীরা। দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় রয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়। তবে এটিও পরোক্ষভাবে আইনজীবীদেরই দখলে। জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে আসা বিচারপতিগণের মধ্যে আপিল বিভাগের একমাত্র বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ।
তিনি ২০১০ সালে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। জেলা ও দায়রা জজ আ ন ম বশীরুল্লাহও একই বছর অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগ লাভ করেন। বিচারপতি সহিদুল করিম (২০১৩), বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (২০১১), বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস (২০১২), বিচারপতি এসএম মুজিবুর রহমান (২০১৫), বিচারপতি আবু আহমেদ জমাদার (২০১৮), বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান (২০১৮), বিচারপতি ফাতেমা নজীব (২০১৮), বিচারপতি মো. কামরুল হোসেন মোল্লা (২০১৮), বিচারপতি এসএম কুদ্দুস জামান (২০১৮), বিচারপতি মো. আতোয়ার রহমান (২০১৮), বিচারপতি মোহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলাম (২০১৯), বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন (২০১৯), বিচারপতি মো. জাকির হোসেন (২০১৯) এবং বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান (২০১৯) জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন। জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে সর্বোচ্চ ৬ জন বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছেন ২০১৮ সালে।
সূত্রটি জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকজন বিচারপতি অবসর গ্রহণ, আপিল বিভাগে উন্নীতকরণ এবং মৃত্যুবরণের ঘটনায় বিচারপতি সংখ্যা কমে যায়। এ শূন্যতা পূরণ এবং হাইকোর্ট বিভাগে বেঞ্চ সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন বিচারপতি নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এবারের নিয়োগে কারা প্রাধান্য পাবেন-আইনজীবী নাকি জুডিশিয়াল সার্ভিস-এ নিয়ে রয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিচারাঙ্গন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বিচারপতি নিয়োগে এবারও আইনজীবীদের প্রাধান্য থাকবে। তবে জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হতে পারে। নিয়োগ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের পরই নিশ্চিত হওয়া যাবে বিষয়টি।
ইবাংলা /টিআর /১৬ জানুয়ারি