বাল্যকালে থেকে জেনেছি, ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জী ( Cherrapunji) নামক স্থানটি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাতের জন্য বিখ্যাত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,২৬৭ ফুট উঁচু। বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু পরিমাণ বৃষ্টি হয়ে থাকে ভূপ্রকৃতিগত অবস্থানের কারণে।
সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার ভারতীয় সীমান্তবর্তী মেঘালয় পর্বতের পাশেই। এই সড়কপথের কারণে পাহাড়ি ঢলের নেমে উজান থেকে নামা আসা বৃষ্টির পানিবাহিত পলিমাটিযুক্ত বানের পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুযোগ না পেয়ে সিলেট বিভাগের জেলাগুলোর ওপর বিস্তার লাভ করে। আমাদের দেশের পুরনো ঘটনা এ গুলো ।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে কয়েক বছর ধরে কয়েকশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কিশোরগঞ্জের তিনটি উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থায় নির্মিত। আর অতীতে সিলেটবাসীর দেখা সব বন্যার চেয়ে ভয়াবহ এবারের পরিস্থিতি। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সিলেটের সঙ্গে সুনামগঞ্জের যোগাযোগ ব্যাবস্থা। প্রতিটা ঘরবাড়ি পানির নিচে। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল সবখানে পানি। আগের সড়ক নিজে তলিয়ে যেয়ে উজানের পানির প্রবাহের সুযোগ করে দিত।
এখন নতুন উঁচু ও অল-ওয়েদার নতুন সড়ক সমাধানের বদলে নিজেই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উজান থেকে ছুটে আসা পানি পূর্বের ন্যায় সড়ক তলিয়ে পাড়ি না দিতে পেরে আশেপাশে হয়ে শহর বন্দরে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট এলাকা দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে উঁচু হওয়ায় পানি সেখানে বেশি দিন স্থায়ী হত না, পানির ধর্মই এমন। এসব পানি বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম এলাকা থেকে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে সাগরে নামে।
জানা যায় এই সড়কপথ মেঘালয় পর্বত থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলের পানির স্বাভাবিক চলাচলের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার কাজ করেছে। দেশে কি কোন গবেষনা আছে কেন হঠাৎ বন্যা হল? সে শহরে তো অনেক মন্ত্রি তন্ত্রি রয়েছেন।দেশে অবশ্য রক্ষক হল ভক্ষক তাঁদেরকে কিভাবে বিশ্বাস করা যায়?।তবে সংশ্লিষ্ট জনদের দিয়ে সার্বিক কাজ না করালে এমনই হতে থাকবে। জনগণ ভুগতেই থাকবে। উন্নত সব দেশ থেকে আমরা ভাল কিছু শিখতে বা নিতে পারি ।
যেমন অনভিজ্ঞ বা সংশ্লিষ্টজন ছাড়া প্রধান মন্ত্রীও কোন প্রজেক্টে নাক গলাতে পারেনা। জবাবদিহি করতে হয় পদত্যাগ করার মত অবস্থা হতে পারে। এথিকস কমিটি তদন্ত করে, খুঁচিয়ে বেনিফিট অফ ইন্টারেস্ট বা beneficial interest বের করে ফেলে। কানাডা আমেরিকায় কোণ প্রকল্পের সমীক্ষাটিও এক্সপার্ট শুধু নামে হলে হবেনা, কাজে হতে হবে। তাঁর উপর অনেক জীবন, জীবিকা, অর্থনীতি নির্ভর করে। বড় বড় কোম্পানিতে শুধু একটি সমীক্ষা বা রিপোর্ট করিয়ে নেবার জন্যও কোটি টাকা দিয়ে এক্সপার্টদের জব দিয়ে পুষে জামাই আদরে। একটি দেশ উন্নতি এভাবেই হয়।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিবৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেছে বিশ্বব্যাপী, বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম না। বন্যা কবলিত অসহায় মানুষগুলো দেখে বুজে হাহাকার করে উঠে। ভারতের যে সুইচ গেট রয়েছে সেগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় অটোমেটিক ভাবে, পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে গেট খুলে যায় ও কমে গেলে বন্ধ হয়ে যায়। ভারতে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা দেখা দেওয়ায় তিস্তা ও টিপাইমুখের মোট ৪৩টি গেট খুলে দেয় আর সেভাবেই তৈরি করা।এ ছাড়াও অতিরিক্ত পানি তখন নানাভাবে উজান থেকে বাংলাদেশে ঢালুতে প্রবেশ করে।
সিলেটে বিভিন্ন এলাকায় টিলা, বনভূমি,পাহাড় ধ্বংস করা হয় বিভিন্ন সরকার আর আমলাদের প্রভাবে, কিছু পাথর ভাঙার কারখানা করে প্রকৃতিকে ক্ষতি করআ হচ্ছে। প্রাকৃতিক পাহাড়ি পরিবেশকে সংস্কার করে বাণিজ্যিক বন ও চাষাবাদের পরিকল্পনায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে সহায়তা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বন কমে যাওয়ায় মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় প্রচণ্ড রকমের পাহাড়ি ভূমি ক্ষয় হয়। ইরোসন বা ভূমিক্ষয় ও সেডিমেনটেশন প্রাকৃতিক নিয়ম। যেমন প্রতি বছর নদী ড্রেজীং করা জরুরী ক’বছর পর পর নয়। নদ-নদীগুলোর নাব্যতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে।
ভূমিক্ষয় কমাতে বৃক্ষরাজীকে রক্ষা ও নতুন করে রোপণ করতে হবে।একজন বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকারঃ “হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো জলের অবাধ প্রবাহ। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয় তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটার এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানি প্রবাহের সুযোগ রাখা হয়। এ বিষয়ে তখন একটি লিখিত প্রস্তাবেও আমি দিয়েছিলাম। এছাড়া এই সড়কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো হলো, এটি একা দাঁড়িয়ে থাকা এক সড়ক, এই সড়ক ব্যাপক অর্থে কোনো সংযোগ তৈরি করছে না।” অতঃপর হবুচন্দ্র রাজার এ দেশে কে শুনে কার কথা?
পরিবেশ সংরক্ষণ ও প্রাকৃতিক রাখা কাকে বলে একটি উদাহরণ;আমাদের উনি, স্বামী আমেরিকার বিখ্যাত কোম্পানি Fluor Corporation-4 (American multinational engineering and construction firm) কনসাল্টেন্ট হিসেবে চাকরি করতেন। ক্যালগেরিতে একটি প্রোজেক্টে অস্থায়ী ক্যাম্প বানানোর জন্য ডিজাইন ও লেআউট করতে গিয়ে কিছু এলাকায় মাঝে গ্যাপ দিয়ে রাখা হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে জানানো হয় ‘ ন্যাচারাল হাবিটাট বা বন্য প্রাণী পাওয়া যাওয়ার কারণে ফাঁকা জমি রাখা হয়েছে। সেই অস্থায়ী ক্যাম্প বানানোর পূর্বে পরিবেশগত সমিক্ষক দলের, রিপোর্টে প্রয়োজন হয়।
কোম্পানি ক্ষতি স্বীকার করে বেশ কিছু জমি ছেড়ে দিতে হয়েছে। কেউ কোন বাক্যব্যায় করেনি। ছেড়ে দেয়া ফাঁকা সেই জমির বাসিন্দা ছিলেন কয়েকটি সোনা ও কুনো ব্যাঙ। ব্যাঙাচি ও অ্যাম্ফিবিয়ান ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শুনেই এত আট ঘাট । আবার বানফে রাস্তার জন্য কিছু গাছ কাটতে হয়েছিল। তার আগে দুজন সার্ভেয়ারকে পাঠিয়ে প্রতি গাছে আঘাত করে দেখতে হয়েছে গাছে কোন পক্ষীকুল বা তাদের নীড় আছে কিনা। দরকার হলে রাস্তা ঘুড়িয়ে নেয়া হবে তবু পক্ষীকুলকে বাস্তুহারা করা যাবেনা।
দেশের অন্যান্য এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো আর হাওড়ের অবকাঠামোর মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। অন্যত্র যেভাবে নির্মাণ করা হয়, হাওরে তা করা যাবে না। সেখানের মানুষের জীবিকাও ভিন্নতর। সড়ক, বনায়ন বা সেতুর মতো বড় অবকাঠামো নির্মাণের আগে বিশেষজ্ঞ মতামত ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা আবশ্যক। নির্মাণের সিদ্ধান্তের আগে যথাযথ পরিবেশগত বা সঠিক সমীক্ষা না হলে “ কোন বিশেষ পদক্ষেপ “ সমাধানের বদলে সমস্যায় “ পরিণত হতে পারে।
আবহাওয়া পূর্বাভাস জেনে, ড্রোনের ব্যাবহার করে বর্তমান প্রযুক্তিকে কাজে লাগান সম্ভব।নৌ ব্যাবস্থা উন্নত ও আধুনিক করা যায়। শেষ কথা প্রকৃতি মাতা থেকে উপকারিতা পেতে হলে প্রকৃতিকে প্রাকৃতিক থাকতে সাহায্য করতে হবে মানুষকে। অপরিকল্পিত স্থাপনা, সড়ক প্রতিবন্ধকতা দিয়ে পানির স্বাভাবিক গতিধারা পরিবর্তন করা যাবে তবে রুদ্ধ করা যাবে না।
ইবাংলা / জেএন / ২৯ জুন,২০২২