মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় আনন্দের ও ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর, প্রভুভক্তির পরম পরাকাষ্ঠা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম পবিত্র কুরবানি। শুধু দৃশ্যমান পশু নয়; বরং এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনই মুমিনের আসল লক্ষ্য। এর সূচনা হয় প্রথম মানব-মানবীর প্রিয় পুত্রদ্বয় হাবিল-কাবিলের হাত ধরে। আর পূর্ণতা পায় জাতির পিতা হয়রত ইব্রাহিম(আঃ) ও তার পুত্র ইসমাইল (আঃ)-এর ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ঘটনার মধ্য দিয়ে; জান্নাতি দুম্বা কুরবানির মাধ্যমে।
পশু নয়, পশুত্ব দমন’ কুরবানির মূল লক্ষ্য। স্রষ্টার প্রেমে বিলীন হওয়ার এটা অন্যতম মোক্ষম মুহূর্ত। বরাবরের মতোই কুরবানি নামক এ মহান পরীক্ষা আমাদের সামনে। এ পরীক্ষার কেন্দ্র হৃদয়ের ছোট্ট কুটিরে ও তার সাবজেক্টের নাম তাকওয়া।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- ‘ ঐ সমস্ত পশুর রক্ত, গোশত আমার কাছে কিছুই পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।’ (সূরা হজ-৩৭)। এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট, আমাদের খোদাভীরুতা ও তাকওয়া অর্জনই কুরবানি কবুলের পূর্বশর্ত। পশুটির গঠন ও দাম কোনটাই আল্লাহর কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং বিবেচ্য বিষয় কু-প্রবৃত্তি পরিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন।
পশুর রক্ত প্রবাহিত হওয়ার আগেই আল্লাহর কাছে পৌছে আমাদের তাকওয়া তাই আত্নার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে তাকওয়া অর্জনই হোক কুরবানী মূল লক্ষ্য।
কুরবানি করা মাংস তিন ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য রেখে বাকি ২ ভাই আত্নীয় ও গরীবদের মাঝে বন্টন করার মানেই হলো ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ- যা কোরবানির অন্যতম শিক্ষা। আমাদের জীবন ও সম্পদের একমাত্র মালিক আল্লাহ। এ দুটি জিনিস আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যয় করাই ইমানের অপরিহার্য দাবি এবং জান্নাত লাভের পূর্বশত। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন।’ (সূরা তাওবা-১১০)।
আমাদের জীবন-সম্পদ আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করার প্রতিশ্রুতিই গ্রহণ করি পবিত্র কুরবানির মাধ্যমে। কুরবানি দেয়ার মধ্যে মৌলিক যে কথাটি আমরা বিশ্বাস করি তা হল- আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সারা জাহানের ‘রব’ আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আল আনআম-১৬২)।
কাজেই আমাদের জীবন ও সম্পদ একমাত্র আল্লাহর এবং তা আমাদের কাছে তার আমানত। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ও তার পছন্দনীয় পথে ব্যয় করাই একান্ত কর্তব্য । কুরবানি এই কর্তব্য পালনের অন্যতম সেরা মাধ্যম।
কুরবানী করা সত্ত্বেও আমরা অনেকেই আছি যারা রাস্তার পাশে, রেললাইনের ধারে অনাহারে-অর্ধাহারে পড়ে থাকা মানুষগুলোর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই না, টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে ব্যর্থ প্রতিবেশী রোগাক্রান্ত মানুষটির দুর্দশা লাঘবে অর্থ ব্যয় করি না।নিজের পাশের বাড়ির এতিম- অসহায় শিশুদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কুন্ঠাবোধ করি। আমানত এবং ওয়াদা রক্ষা করিনা। অহরহ এবং প্রতিনিয়তই মিথ্যা কথা বলেই যাচ্ছি।লোভ-লালসা, অতিভোগ, অর্থ, দূর্নীতি, সম্পদ আর আভিজাত্য অর্জনের পেছনে লাগামহীন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বিরামহীন ছুটে মনুষ্যত্বের মহত্তম গুন থেকে পশুর চেয়েও অধম অবস্থানে নেমে এসেছি।
আমাদের সমাজে এখনো সত্যিকারের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার প্রকৃত কারণ হচ্ছে আমরা পশু কুরবানি দিলেও আমাদের মনের ভেতরে লুকায়িত উপরিউক্ত কু- প্রবৃত্তি বিসর্জন দিতে পারিনি।আমাদের ভেতর লুকিয়ে থাকা শয়তানরূপী পশুটাই সত্য ও সুন্দরের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এই পশুত্বই আমাদের মনের সকল মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিচ্ছে।
পবিত্র ঈদুল আজহায় প্রতি বছর কুরবানি আসে, কুরবানি যায়, আল্লাহর নামে লক্ষ লক্ষ পশু জবাই হয়, কয়েক দিন আনন্দ করে অতঃপর সবাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে কোনো পরিবর্তন আসে না, ন্যায়বিচার আজও নির্বাসিত। পশু কুরবানির পাশাপাশি আমাদের ভিতরের পাশবিকতা, নির্মমতা কি বিসর্জন করতে পেরেছি? সম্ভবত পারিনি – যার জন্য পৃথিবীতে অন্যায়- অত্যাচার, মারামারি, হানা-হানি, হিংসা-বিদ্বেষ, খুন-রাহাজানিসহ দিনদিন অনেক অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে । তাই পশু কুরবানির পাশাপাশি মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করার মধ্যদিয়ে সকল অশুভ শক্তি দমন করতে হবে।
অনেকেই বাহ্বা পাওয়ার জন্য ও আলোচিত ব্যক্তিত্ব হওয়ার লক্ষ্যে লক্ষাধিক টাকার গরু বা উট কিনে গলায় মালা পরিয়ে, মাথায় লাল ফিতা বেঁধে পথে পথে ঘোরান। এটা যেমন ঠিক নয়, তেমনি কোনো ধনাঢ্য ব্যক্তির জন্য জীর্ণশীর্ণ কম দামি পশু কোরবানিও অনুচিত।
আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে যে, ‘কুরবানি না দিতে পারলে লজ্জার ও কূরবানি দেওয়া গর্ব ও অহংকারের – আসলে দুটির কোনটিই সত্য নয় । ঈদ-উল-আজহায় কোরবানির পশু জবাই দেয়া ওয়াজিব। যার সামর্থ্য আছে সে কুরবানি দিবে, যার সামর্থ্য নেই তার জন্য বাধ্যবাধকতা নেই। সে ঈদের অন্যান্য নিয়মকানুন মেনে চলবে।
দেখা গেছে কিছু মানুষ কুরবানীর ওয়াজিব বিধান পালন করতে গিয়ে আসল ফরজ বিধানের প্রতি বে-খবর । নামাজের খবর নেই গরু নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। এ ফরজ নামাজ মিস হলে লক্ষ ওয়াজিব দিয়ে পূরণ করা আধৌ কি সম্ভব?
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কোরবানির পশুর মাংস, রক্ত কিছুই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে না; পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া। আর এই তাকওয়ার উপস্থিতি না থাকলে পশু কুরবানির কোনো সার্থকতা নেই। এজন্য নিষ্পাপ পশুর গলায় ছুরি চালানোর আগে নিজের মনের পশুটাকে কোরবানি দিতে হবে।
বছরের পর বছর ধরে মনের কোণে ঘাপটি মেরে থাকা অসভ্য পশুটি জবাই না দিতে পারলে গতানুগতিক পশু কোরবানিতে কোনোই ফায়দা নেই। পশু কুরবানীর পাশাপাশি ক্রোধ, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা ইত্যাদি দমনের মাধ্যমে তাকওয়া, আত্মমর্যাদা, মমতা-ভালোবাসা, ত্যাগের মানসিকতা ও মূল্যবোধ অর্জন করতে হবে।
তাই শুধু পশু নয়, মনের পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে সকল মানবিক মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে আত্নার পরিশুদ্ধির মধ্যদিয়ে সমাজে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে দেওয়াই হোক কুরবানীর প্রকৃত শিক্ষা।
ইবাংলা/জেএন/৮ জুলাই,২০২২