২৩ থেকে ২৭ অগাস্ট পর্যন্ত চায়না মিডিয়া গ্রুপের সিআরআই অনলাইন ওয়েবসাইট‘ চীনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান-২০২২’ শীর্ষক ধারাবাহিক অনলাইন সম্প্রচার অনুষ্ঠানের ‘হ্যালো, ইছাং’ পর্ব আয়োজন করে।
বাংলাদেশ, ব্রিটেন, ইতালি, স্পেন, ব্রাজিল, জর্জিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা হুপেই প্রদেশের ইছাং শহরে যান। তারা বিশ্ব বিখ্যাত ‘তিন গিরিখাত প্রকল্প’ এবং এ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যময় সংস্কৃতি উপভোগ করেন।
ইয়াংজি নদী বা ছাংচিয়াং, চীনা জাতির মাতৃনদী। তিন গিরিখাত হলো ছাংচিয়াং সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিন গিরিখাত প্রকল্প বিশ্বের বৃহত্তম জলসেচ প্রকল্প। তিন গিরিখাত যাত্রায় আমরা ‘দুটি বাঁধ ও একটি গিরিখাত’ দেখেছি। যা চীনের প্রথম বাঁধ-গেচৌপা বাঁধ, বিশ্বের প্রথম বাঁধ-তিন গিরিখাত বাঁধ এবং তিন গিরিখাত প্রকল্প।
গেচৌপা বাঁধটি ছাংচিয়াং নদীর প্রথম বাঁধ। ১৯৭০ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৮ বছর পর ১৯৮৮ সালে বাঁধ নির্মাণ শেষ। এ বাঁধের দৈর্ঘ্য ২৬০৬.৫ মিটার, উচ্চতা ৭০ মিটার। ছাংচিয়াং নদীর প্রধান অংশে চীন নিজের উদ্যোগে নকশা, নির্মাণকাজ, প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপনা করেছে। এটি চীনের প্রথম বড় ধরনের জলসেচ প্রকল্প। গেচৌপা বাঁধ নির্মাণের সময় জলবিদ্যুৎ সংক্রান্ত নানা প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধান করা হয়। যা পরবর্তীতে তিন গিরিখাত প্রকল্প নির্মাণে সহায়তা করে।
আরও পড়ুন—–ভয়াবহ বন্যায় পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে
১৯৮৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক গ্রুপ তিন গিরিখাত প্রকল্প নির্মাণের বিষয়ে আলোচনা করে। এরপর ‘তিন গিরিখাত প্রকল্প উন্নয়ন জেনারেল কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ছাংচিয়াং তিন গিরিখাত অঞ্চল ১৯৯৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর, তিন গিরিখাত প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এ প্রকল্পটি চীনের হুপেই প্রদেশের ইছাং শহরের সানতোপিং জেলার কাছে গেচৌপা জলসেচ প্রকল্প থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তিন গিরিখাত প্রকল্পের প্রধান কাজ হলো বন্যা প্রতিরোধ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌপরিবহন, মৎস্যচাষ, পর্যটন, পরিবেশ সুরক্ষা ও পরিচ্ছন্নকরণ, স্থানীয় অধিবাসীদের স্থানান্তর ও পুনর্বাসন, দক্ষিণ চীনের পানি উত্তর চীনে আনা এবং পানি সরবরাহ ও জলসেচ ইত্যাদি।
তিন গিরিখাত জলাধারে সংরক্ষিত পানির উচ্চতা ১৭৫ মিটার। জলাধারে মোট ৩৯৩০ কোটি কিউবিক মিটার পানি রাখা যায়। বন্যা প্রতিরোধে ২২১৫ কিউবিক মিটার পানি ধারণ করা যায়। তিন গিরিখাত জলাধার নির্মাণের পর ছাংচিয়াংয়ের মধ্য ও নিম্ন অববাহিকার বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থায় মৌলিক ভূমিকা পালন করে এবং ইছাং থেকে ছোংছিং-গামী নদীপথের সংস্কার করা হয়।
এখন দশ হাজার টন নৌবহর ইছাং থেকে সরাসরি ছোছিংয়ে যাতায়াত করে।জানা গেছে, তিন গিরিখাত নির্মাণের আগে ছোছিং থেকে ইছাংগামী ছয় শতাধিক কিলোমিটার নদীপথে পানির স্রোত অনেক বেশি ছিল, নদীতে ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাও ছিল অনেক। রাতে নদীপথে যাওয়া যেতো না। একদল মানুষ মোটা দড়ি দিয়ে জাহাজ টেনে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান পার করতো। তিন গিরিখাত জলাধার নির্মাণের পর নদীর পানির উচ্চতা বেড়েছে, স্রোত মন্থর হয়েছে। ছোছিং থেকে ইছাংগামী নদীপথ তৃতীয় শ্রেণীর নৌপথ থেকে প্রথম শ্রেণীর নৌপথে পরিণত হয়েছে। যেন-মেঠোপথ বদলে গিয়ে জলপথে পরিণত হয়েছে। নৌপথের নিরাপত্তা বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ এলাকায় নৌ-দুর্ঘটনা হয়না বললেই চলে।
ছাংচিয়াংয়ের উচ্চ অববাহিকার পানির স্রোত কমে যাওয়ায় জাহাজের পণ্য বহনের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। অতীতে এ নদীতে সাধারণত ৩০০০ টনের জাহাজ চলত। এখন ৫০০০ টনের জাহাজ বেশি দেখা যায়। নৌপথের অবস্থা ভালো হওয়ায় জাহাজের কিলোমিটার প্রতি তেল খরচ আগের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ কমেছে। ২০০৩ সালে তিন গিরিখাত বাঁধ চালু হওয়ার পর দেশে জিনিস পত্রের দাম বাড়লেও, তিন গিরিখাত দিয়ে নৌপরিবহনে কোন খরচ হয়না। বরং,ব্যয় সাশ্রয় হয়। যা তিন গিরিখাত প্রকল্পের বাস্তব কল্যাণ।
তিন গিরিখাত ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎকেন্দ্র
২০০৩ সালের জুলাই মাসে তিন গিরিখাত জলসেচের বিদ্যুৎ উৎপাদন-কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এর বার্ষিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ঘণ্টায় ৮৮২০ কোটি কিলোওয়াট।
আরও পড়ুন……..তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান
ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নজর কাড়ে। চলমান জেনারেটরে লাল বাতি জ্বলতে দেখা যায়। দূরের দেওয়ালে চীনের জাতীয় পতাকা উজ্জ্বলতা ছড়ায়। তিন গিরিখাত প্রকল্প দেখে ‘বড় দেশের ভারী প্রকল্প’ কথাটির অর্থ আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তিন গিরিখাতের দু’তীরের পাহাড়ি অঞ্চলে থুচিয়া জাতির অনেক লোক বসবাস করেন। তিন গিরিখাত প্রকল্প নির্মাণের কারণে দু’তীরের লোকজনকে স্থানান্তর করতে হয়েছে। তাদের ভালোভাবে পুনর্বাসন করার ক্ষেত্রে চীন সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে।
থিয়েন লোং শান ৪৭ বছর বয়সী থিয়েন লোং শান ছিংচিয়াং নদীর পাশে বড় হয়েছেন। এখন তিনি ছিংচিয়াং পর্যটন স্থানে কাজ করেন। তিনি জানান, জলাধার নির্মাণের জন্য সরকার নদীর দু’তীরের অধিবাসীদের সুষ্ঠুভাবে স্থানান্তর করেছে। প্রথমে অর্ধেক অধিবাসীদের পাহাড়ি অঞ্চলে স্থানান্তর করা হয়। তাদের জীবনযাপনের সুবিধার্থে স্থানীয় সরকার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে বা অন্যত্র স্থানান্তর করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফলের বাগান করেছেন, কেউবা গ্রামীণ হোটেল খুলেছেন, কেউ আবার স্থানীয় পর্যটন কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছেন।
দেশের পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে থিয়েন লোং শান বলেন, ‘আমার ছোটবেলায় বিদ্যুৎ ছিল না। বাড়িতে কেরোসিন বাতি জ্বলত। আমরা ম্যাচ ব্যবহার করতাম। এখন আমরা কম্পিউটার, ড্রোন, ক্যামেরা-সহ নানা উচ্চমানের সরঞ্জাম ব্যবহার করি। অল্প কয়েক দশকের মধ্যে আমরা প্রাচীন জমি চাষের পদ্ধতি পরিবর্তন করে আধুনিক সভ্যতার পর্যায়ে পা রেখেছি।
আমি অনেক আনন্দিত। আমি গর্বিত যে, আমার জন্মস্থান ত্যাগ করিনি। আমি স্বদেশের আকাশ-পাতাল পরিবর্তন দেখেছি। চীন সরকারের নগরায়ন প্রতিষ্ঠা, প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্যমোচন এবং বর্তমান গ্রামাঞ্চলের পুনরুত্থান নীতি আমাদের দেশের উন্নয়নে প্রকৃত সহায়তা দিয়েছ আমরা এর সুবিধাভোগী।” সূত্র:সিএমজি।
ইবাংলা/মআ/ ৩০ আগস্ট,২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.