বিদ্যাপীঠে ১০/১৫ বছর কাটানোর পর শেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করেন সবাই। একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে স্কুলের শেষ দিনটি উদযাপনের নাম ছিল ‘বিদায় অনুষ্ঠান’ বা ‘ফেয়ার ওয়েল’। তবে সময়ের আবর্তনে এখন তা হয়ে উঠেছে ‘র্যাগ ডে’। যেটাকে উচ্ছৃঙ্খলতার নামান্তর বলছে অনেকে।
সাদা টি-শার্ট গায়ে চলছে উদ্দাম নাচ, হচ্ছে ডিজে পার্টি, একে অপরকে জড়িয়ে ধরছেন শিক্ষার্থীরা। কেউ মেতেছেন রং খেলায়, আবার কেউ বন্ধুদের টি-শার্টে লিখছে অশ্লীল সব বার্তা। যেসব শব্দ সীমা ছাড়াচ্ছে অশ্লীলতার। এভাবেই এখন উদযাপিত হয় স্কুলজীবনের শেষ দিন! যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘র্যাগ ডে’।এমনই চিত্র সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে ডি.কে আইডিয়াল কলেজ ক্যাম্পাসে।
আরও পড়ুন…নড়াইলে রেড ক্রিসেন্ট’র আজীবন সদস্যদর মতবিনিময় সভা
র্যাগ ডে উদযাপনের সময় দেখা গেছে উচ্ছৃঙ্খলতা আর অনৈতিকতার বিভিন্ন দৃশ্য। স্কুল ছাড়ার আগে ভেঙে দেওয়া হয় শিক্ষাজীবনে ব্যবহৃত বেঞ্চ ও টেবিল। নষ্ট করা হয় দেওয়াল কিংবা টয়লেট। বাঁকা করে দেওয়া হয় ফ্যানের পাখা। সেগুলো আবার মোবাইল ফোনে ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় টিকটকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুধু স্কুল নয়, ‘র্যাগ ডে’ নামের এমন কালো থাবা ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
আজ সরেজমিনে এমন টি-শার্টে অশ্লীল কথাবার্তা লেখা,ছেলে মেয়েদের একসাথে উদ্দাম নাচসহ নানা অশ্লীল কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে ডাসারের ডি.কে আইডিয়াল কলেজ ক্যাম্পাসে। যে স্কুল-কলেজে শৈশব-কৈশোর কাটে, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জীবনের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে দেয়, বিদায়বেলায় সেই স্কুল-কলেজের সঙ্গেই কেন এমন নিষ্ঠুর আচরণ?
শিক্ষার্থীরা বলেন, টি-শার্টে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয় সেগুলো আসলে ব্যবহার করার মতো না। স্কুলের চেয়ার বা বেঞ্চ ভাঙা এগুলো র্যাগডে বা আনন্দের মধ্যে পড়ে না। স্কুল থেকে খারাপ বদনাম নিয়ে যাওয়া তো উচিত না। আগের যে বিদায় অনুষ্ঠানটা করা হতো এখন আর সেটা করে হচ্ছে না তার পরিবর্তে র্যাগ ডে পালন করা হচ্ছে।
বলা হয়, নৈতিকতা আর মূল্যবোধ শেখার আঁতুড়ঘর হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, শিক্ষার পাশাপাশি শিশুর মন-মানসিকতার মূল ভিত্তি গড়ে ওঠে এ তীর্থস্থানে। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণে শিক্ষকদের নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।সরেজমিনে দেখা গেছে, ডি.কে কলেজ প্রাঙ্গণেই হচ্ছে ডিজে পার্টি বা অনৈতিক কাজ।আর এসব পার্টি হচ্ছে কলেজের শিক্ষকদের সামনেই।রাত পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানে কলেজের অধ্যক্ষসহ অনেক শিক্ষকদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে।
সরকারি শেখ হাসিনা কলেজের এক শিক্ষক বলেন,
এটা একটা অপসংস্কৃতি।এধরনের অনুষ্ঠান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পালনে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।ডি.কে কলেজের প্রিন্সিপালের তো এ বিষয়ে অবগত থাকার কথা।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে তো চিঠি দেওয়া আছে।এসব অনুষ্ঠানের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অশ্লীল কর্মকান্ড চলতে পারেনা।একজন শিক্ষক হিসেবে এসব শুনে আমারই খারাপ লাগছে।
আরও পড়ুন…নড়াইলে কমিউিনিটি পুলিশিং ডে পালন
একসময় মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে স্কুল থেকে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হতো। নাম ছিল ‘বিদায় অনুষ্ঠান’। সেদিন শিক্ষকদের কাছে অতীতের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে চোখের জলে বিদায় নিতেন শিক্ষার্থীরা। অতীতের সেই শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন অভিভাবক। স্কুলজীবনের সেই ‘বিদায় অনুষ্ঠান’ আর বর্তমানের ‘র্যাগ ডে’ কী চোখে দেখছেন তারা?
একজন অভিভাবক বলেন,আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম বিদায় অনুষ্ঠানের ব্যাপারটা চলে আসত তখন দেখা যেত হৃদয় ভারাক্রান্ত মন নিয়েই কিন্তু এ অনুষ্ঠানটি করতাম। র্যাগ ডের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা চিন্তাই করতাম না। আমাদের পরিকল্পনা থাকত যে সে একটা দোয়ার মাহফিল হবে জুনিয়র ছাত্ররা যারা আছে তারা আমাদের বিদায় অনুষ্ঠানটি খুব সুন্দরভাবে আয়োজন করত।
তিনি আরও বলেন, আমি অভিভাবক হিসেবে বলব আমাদের ছেলেমেয়েরা মানুষের মতো মানুষ হোক এবং আনন্দ করুক। র্যাগডে নামক যে প্রহসনমূলক যে অনুষ্ঠান হচ্ছে এ অনুষ্ঠান গুলো বন্ধ হোক। শিক্ষার্থীদের এমন আচরণকে মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবেই দেখছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, এখনই সময় প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ডাসারের সচেতন নাগরিক মোঃদবিরুল ইসলাম বলেন, কে কি মনে করল সেটা তারা মনে করে না। সে কারণে এ উচ্ছৃঙ্খলাটা দেখা যায়। এটা কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা সব সমাজে দেখা যাবে না। এটা কিন্তু তারাই করে যাদের বেড়ে ওঠাটা সুন্দর হয়নি, যাদের মধ্যে মূল্যবোধের সংকট আছে। এটা রোধ করার উপায় হলো আমাদের বাংলাদেশে এখন প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধের চর্চা থাকা উচিত।
যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষার্থীর নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে দেয়, বিদায় বেলায় সেই স্কুলের সঙ্গেই র্যাগ ডের নামে এখন চলছে উচ্ছৃঙ্খলতার চর্চা। স্কুলের শেষদিনটিকে স্মৃতিময় করে রাখতে গিয়ে নতুন প্রজন্ম জড়াচ্ছে অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায়। তাই প্রশ্ন উঠতেই পারে, আসলেই কী প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে তারা? এ বিষয়ে ডি.কে কলেজের ব্যবসা শাখার শিক্ষক সেলিম রেজার কাছে জানতে চাইলে, তিনি কথা না বলে বিষয়টি এড়িয়ে চলে যান।
আরও পড়ুন…‘সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ আহরণে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডি.কে কলেজের আরেক শিক্ষক বলেন,কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত কলেজে এমন ঘটনা ঘটেনি কিন্তু আমাদের এই প্রিন্সিপাল স্যার যোগাযোগদানের পর থেকেই কলেজে অনেক দূর্নীতি অনিয়ম দেখা দিচ্ছে। এ বিষয়ে ডি.কে কলেজের অধ্যক্ষ ড.খন্দকার মোঃসোহেলকে মুঠোফোনে একাধিক বার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ইবাংলা/জেএন/২৯ অক্টোবর ২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.