ঢাকা: রাজধানীর ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পে যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় অতিরিক্ত ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ভবন নির্মাণের ব্যয়েও রয়েছে অসঙ্গতি। ‘ঢাকার মিরপুরস্থ দারুস সালামে ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইউনিট-২ স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার নিজস্ব তহবিল হতে ১০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। খবর সংশ্লিষ্টর সূত্রের।
এই প্রস্তবটি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে গত রোববার প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ের সংশ্লিস্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মো.কামরুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, এ বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলার সুযোগ আমার নেই। যদি কিছু বলতে হয় তাহলে মহাপরিচালক স্যারই বলবেন।
একই মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা জানান, প্রকল্পের যন্ত্রপাতির ব্যয় প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসনের রেট সিডিউল অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কম বা বেশি ধরা হলেও পরবর্তীতে নিদিষ্ট কমিটির মাধ্যমে ক্রয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। তবে পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ বিবেচনায় নেওয়া হবে।
পিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (এনসিডিসি অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় সারাদেশে প্রধান প্রধান এনসিডিএস চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এক্ষেত্রে কাজের দ্বৈততা পরিহার নিশ্চিতকরণের বিষয়ে রাজস্ব খাতের কিছু অঙ্গ-টেন্ডার ডকুমেন্ট ও বিজ্ঞপ্তি, সম্মানি বাবদ ৩ লাখ টাকা এবং ৫ লাখ টাকা প্রাক্কলন করা হলেও এই কাজের বিস্তারিত বিভাজন দেওয়া হয়নি। চিকিৎসা যন্ত্রপাতি (৪৯৬টি) ক্রয় বাবদ ১৬ কোটি ৩৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। যন্ত্রপাতির সংখ্যাও ব্যয় অত্যধিক প্রতীয়মান হয়, যা যৌক্তিক পর্যায়ে হ্রাস করা যেতে পারে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে প্রস্তাবিত মেডিকেল যন্ত্রপাতির মূল্য যৌক্তিকভাবে পুনরায় নির্ধারণ করার জন্য এর আগে পিইসিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের আংশিক মূল্য তালিকা ও বাজার মূল্যের ভিত্তিতে মেডিকেল যন্ত্রপাতির মূল্য প্রাক্কলন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির কোনো স্পেসিফিকেশন দেওয়া হয়নি, যা থাকা প্রয়োজন।
পিইসি সভার কার্যপত্রে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের পূর্ত ও নির্মাণ খাতে মোট ৭ কোটি ৯৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এরমধ্যে ছয় তলায় ১ হাজার ৪৯৯ বর্গমিটার ভবনের নির্মাণ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ কোটি ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা। গণপূর্ত অধিদফতরের ২০১৮ সালে রেট সিডিউল মোতাবেক প্রতি বর্গমিটারের নির্মাণ ব্যয় ৩৩ হাজার টাকা। সে হিসাবে ১ হাজার ৪৯৯ বর্গমিটার ভবনের নির্মাণ ব্যয় হবে ৪ কোটি ৯৪ হাজার ৬৭ লাখ টাকা। এটি প্রস্তাবিত প্রাক্কলনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ প্রাক্কলনটি বাস্তবসম্মত ও যথাযথভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এছাড়া ছয় তলায় প্রস্তাবিত হাসপাতাল ভবনের ড্রইং, ডিজাইন ও লে-আউট প্ল্যান ডিপিপিতে সংযুক্ত নেই, যা সংযোজন করা প্রয়োজন। ডিপিপির ক্রয় পরিকল্পনায় মেডিকেল যন্ত্রপাতি ক্রয়ের জন্য ৭টি প্যাকেজ করা হয়েছে, যা অত্যাধিক। এক্ষেত্রে প্যাকেজ সংখ্যা যুক্তিসঙ্গতভাবে হ্রাস করে যথাযথভাবে ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।
আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পটি স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সঙ্গে নিবিড় সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে অনুযায়ী প্রস্তাবিত প্রকল্প ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন হবে। এমটিবিএফ (মধ্যমেয়াদী বাজেট কাঠামো) প্রত্যায়নে ৩ বছরের প্রক্ষেপণগুলো ধারাবাহিক ও যথাযথ হয়নি। এমটিবিএফ এর বরাদ্দ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ নেই। এগুলো সংশোধন করে এমটিবিএফ প্রত্যয়ন পত্র সংযুক্ত করা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে- দারিদ্র দূরীকরণ এবং জনগণের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন সরকারের দুটি অন্যতম অগ্রাধিকার। বর্তমান স্বাস্থ্যনীতি, ভিশন ২০২১, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং জনসংখ্যা উন্নয়ন কৌশলেও জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর হতে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ডায়াবেটিস রোগের নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসার নিরলসভাবে কাজ করছে। ডায়াবেটিস একটি জটিল ও অনিরাময়যোগ্য রোগ এবং অন্যান্য সকল রোগের উৎস হিসেবে কাজ করে, যার মধ্যে হৃদরোগ অন্যতম। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে হৃদরোগজনিত রোগীর সংস্থা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত বারডেমের সঙ্গে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইকরি) ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের আধুনিক ও যুগোপযোগী চিকিৎসা দেওয়া হয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার ইকরি’র স্বল্প পরিসরে হৃদরোগীদের স্থান সংকুলানসহ চিকিৎসা সেবা দেওয়া দূরহ হয়ে পড়ছে। এ জন্য কার্ডিয়াক চিকিৎসা সেবা সম্প্রসারণের জন্য বাডাস’র অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স (বিআইএইচএস) হাসপাতালের নির্মাণাধীন ১২ তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় ৩০ শয্যা বিশিষ্ট পরিপূর্ণ বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপনের উদ্দেশ্য এই প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়। বেসরকারি প্রচেষ্টায় আর্থ-সামাজিক খাতে গৃহীত প্রকল্পের সরকারি সাহায্য দেওয়ার নীতিমালার জন্য প্রত্যাশি সংস্থা, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ৪০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ও সরকারি ৫৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ অর্থায়নে সমাজ সেবা মন্ত্রণালয়ের আওতায় সমাজসেবা অধিদফতরে মোট ২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ২০১৯ সালের জুলাই হতে ২০২২ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাব করা হয়।
প্রকল্পটির ওপর প্রথম প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি (পিইসি) সভা ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) পূর্ণগঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে চলতি বছরের জুলাই হতে ২০২৪ সালের জুনে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের পুনর্গঠিত ডিপিপি পাঠানো হয়, যা চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনে পাওয়া যায়।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে, ১২তলা বিশিষ্ট নির্মাণাধীন বিআইএইচএস ভবনের ষষ্ঠ তলা নির্মাণ, একটি পেশেন্ট বেড কাম প্যাসেঞ্জার লিফট স্থাপন, এয়ারকন্ডিশনিং সুবিধা স্থাপন, একটি ২৫০ কেভিএ জেনারেটর স্থাপন, ১৪৮টি আসবাবপত্র ক্রয় এবং ৪৯৬টি চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয়।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সম্প্রসারণ করে ৩০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ করে হৃদরোগের প্রতিষেধক, প্রতিকারক এবং উন্নতিবর্ধন চিকিৎসা সেবা দেওয়ার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টি করা। এছাড়া দরিদ্র অসহায় ও সুস্থ রোগীদের ৩০ শতাংশ বিনামূল্যে হৃদরোগের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি এবং জনসাধারণের স্বাস্থ্যের সার্বিক উন্নতি সাধন ও সরকারিসহ অন্যান্য হাসপাতালে হৃদরোগীর চাপ হ্রাস করা।
পিইসি সভার কার্যপত্রে পরিকল্পনা কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, পরিকল্পনা বিভাগ জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী এই প্রকল্পের ডিপিপি’র ফরমেটে কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি হয়েছে, যা সংশোধন করা প্রয়োজন। ৩ দশমিক শূন্য অনুচ্ছেদে প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যমাত্র সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পের উদ্দেশ্য সুনির্দিষ্ট, পরিমাপযোগ্য, অর্জনযোগ্য, প্রাসঙ্গিক ও সময়াবদ্ধ এবং লক্ষ্যমাত্রাগুলো কার্যক্রম ভিত্তিক হওয়া সমীচীন।
প্রকল্পটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদফতর এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডস) প্রস্তাবিত। প্রকল্পের বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ হতে এর আগে দু’দফায় মতামতে উল্লেখ রয়েছে যে, অ্যালোকেশন অব বিজনেস অনুযায়ী সিডিউল-আই অব রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ অনুযায়ী স্বাস্থ্য সেবা বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন বিষয়ক যেকোনো কাজ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আওতাধীন। সে হিসাবে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রস্তাবিত বিশেষায়িত কার্ডিয়াক ও থোরাসিক হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পটি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আওতায় বাস্তবায়িত হওয়া সমীচীন। তবে জনকল্যাণে প্রকল্পটির গুরুত্ব বিবেচনায় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়নের জন্য স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের মতামত নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
আরও বলা হয়েছে, সমাজসেবা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তাকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ ও অপর ২ জন জনবলের বেতন ভাতা বাবদ মোট ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রাক্কলন করা হলেও জনবলের বিষয়ে অর্থ বিভাগের জনবল কমিটির অনুমোদন নেওয়া হয়নি। অর্থ বিভাগের চলতি বছরের ৯ মার্চ পত্র মোতাবেক যে সকল প্রকল্পে ন্যুনতম সরকারি আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে তা ঋণ বা অনুদান যে রকম হোক না কেন, এ সকল প্রকল্পের জন্য জনবল সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি