‘ভারত-পাকিস্তান’ শব্দযুগল যখনই এক বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তখনই উপমহাদেশজুড়ে, বিশেষ করে দেশ দুটির প্রায় দুই শত কোটি মানুষের মনে অন্যরকম এক যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করে। আরো পরিষ্কার করে বললে, এই দুটি দেশের মধ্যে ক্রিকেটযুদ্ধ যেন রাজনৈতিক লড়াই, রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং প্রকৃত যুদ্ধকে অতিক্রম করেছে। যদিও ক্রিকেট একটি খেলা, দুই দেশের মধ্যে বিশ্বকাপ পর্যন্ত এই লড়াই যেন যুদ্ধের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।
দুই দেশের ভক্তদের মধ্যে চাওয়া একটাই। তা হলো তাদের নিজেদের দল বিজয়ী হোক- তা সে যেকোন মূল্যেই হোক। বিশ্বের যেকোনো খেলায় যেকোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে অতিক্রম করেছে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ। ভক্তদের হৃদয়ে চাপা এক উত্তেজনা। টি২০ বিশ্বকাপ সুপার ১২-এর লড়াইয়ে পাকিস্তান ও ভারত যখন মাঠে নামছে আজ, তখন তাদের হৃদয়ও স্পন্দিত হচ্ছে।
একে সিম্পলি একটি খেলা হিসেবে বর্ণনা করেছেন ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি। কিন্তু বাস্তবে এটা এক যুদ্ধ। ক্রিকেটের যুদ্ধ। চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়ানো। সবটুকু শক্তি বিসর্জন দিয়ে তাদের অন্য মাত্রার এক বাঁচামরার লড়াই। বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়েও যেন আজকের ২২ গজের যুদ্ধ অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
নিশ্চিত করে বলা যায়, আজও কিছু টেলিভিশন সেট ভাঙা হবে। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের পরের দিন এমন অনেক খবর পাওয়া যায় যে, বিভিন্ন স্থানে ক্ষুব্ধ ভক্ত টিভি সেট ভেঙে ফেলেছেন। এটা দুই দেশেই হলেও পাকিস্তানে তা বেশি। সামাজিক মিডিয়া সয়লাব হয়ে যায় এমন ভিডিও, ছবিতে।
তাতে দেখা যায়, টিম পরাজিত হওয়ায় ভক্তরা তাদের টিভি সেট লাঠি দিয়ে আঘাত করে অথবা উপরে তুলে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলছেন। এর কারণ, তারা দলের পরাজয় মেনে নিতে পারেন না। অন্য দলের বিরুদ্ধে পরাজয়কে যেভাবে ভক্তরা মেনে নিতে পারেন, ভারত-পাকিস্তানের খেলায় নিজের দলের তেমন পরাজয় তারা মেনে নিতে পারেন না।
এর কারণ, তাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় বিভিন্ন কারণ। সব মিলে পরিস্থিতি এমন যে, ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত হারতে পারবে না। আবার ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান হারতে পারবে না। ভক্তদের এই উচ্ছ্বাস, এই আবেগ- এই ক্রিকেট খেলাকে দিয়েছে একটি ‘যুদ্ধের’ তকমা। তাই এই খেলাকে দেখা হয়, ফাইনালের আগে ফাইনাল হিসেবে। এখন তা শুধু ভারত উপমহাদেশের মধ্যেই প্রচলিত এমন নয়। এই ধারণা এখন বিশ্বজুড়ে সবাই জানেন।
দুই দলই একে শুধু একটি খেলা, একটি ম্যাচ বলে আখ্যায়িত করলেও এর মাজেজা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এর উত্তাপ পাকিস্তানে বর্তমান ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গায়েও গিয়ে লাগে। কারণ, পাকিস্তান ক্রিকেটের জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি। আর ভারতের সঙ্গে তার চলছে রাজনৈতিক উত্তেজনা, বিশেষ করে কাশ্মীরকে ইস্যু করে সেই উত্তেজনা এতটাই বেশি যে, বার বার তার দেশ জাতিসংঘে এ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে যাচ্ছে। ইমরান খানের ভিতর শুধু রাজনীতি নয়, একই সঙ্গে তিনি নিজে ক্রিকেটার, সেই উত্তেজনা তার রক্তেও আছে।
ভারতের সঙ্গে ম্যাচের প্রাক্কালে তার সঙ্গে এবং পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান রমিজ রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন পাকিস্তানি ক্রিকেটার বাবর আজম। তারা তাকে কি মন্ত্র দিয়েছেন, তা জানা যায়নি। তবে বাবর আজমের চেয়ে অনেক বড় বিরাট কোহলি- এমন সাক্ষ্য দিয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার শোয়েব আখতার। আর ভারতের সাবেক অধিনায়ক গৌতম গাম্ভির তো দাবি করে বসেছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি২০ বিশ্বকাপ খেলায় টিম ইন্ডিয়ার ওপর কোন রাজনৈতিক চাপ কাজ করবে না।
এই যখন অবস্থা তখন ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের সমর্থকদের প্রার্থনার ছবিতে সয়লাব ইন্টারনেট। তারা প্রার্থনা করছেন, তাদের দল যেন বিজয়ী হয়। তাদের একটাই কামনা, তাদের দল যেন এই খেলায় পরাজিত না হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দিনশেষে একটি দলই বিজয়ী হয়। এতে ভক্তদের মধ্যে দেখা দেয় এক মর্মবেদনা। বেদনায় মুষড়ে পড়তে দেখা যায় অনেককে।
পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বকাপ ফুটবলের একদিনের ম্যাচ বা টি২০ ম্যাচে ভারতকে পরাজিত করতে পেরেছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। বিশ্বকাপে এই দুটি দেশের মধ্যে ১২টি ম্যাচ হয়েছে। তাতে প্রতিবারই নিজেদের সদর্প উপস্থিতি জানান দিয়েছে নীল জার্সি বাহিনী। টি২০ তে ৫টি বারে প্রতিবারই পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে ভারত।
এমনকি ২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড টি২০ ফাইনালেও একই ফল। এ অবস্থায় পাল্লাটা ভারতের দিকেই ঝুঁকে আছে। মনস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক শক্তি দিয়ে যদি বাবর বাহিনী সেই ধারণাটাকে পাল্টে দিতে পারে, তাহলে হয়তো পাকিস্তান ফেটে পড়বে উল্লাসে। ভারত যদি বিজয়ী হয়, তাহলে ঠিক একই চিত্র দেখা যাবে।