ডিজিটাল দেশে ডিজিটাল বদলিতে অ্যানালগ দুর্নীতির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ডিজিটাল করা হয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলির কার্যক্রম। এতে দেখা দিয়েছে আরেক বিপত্তি। সারাদেশে ১৩শ ১৬ জন শিক্ষকের বদলি আবেদন পেন্ডিং (আটকে) রেখেছেন জেলা ও উপজেলা/থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।

যেটা বদলির নিয়মবহির্ভূত। এ কারণে অভিযুক্ত ৯৫ কর্মকর্তাকে শোকজ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কোনো কোনো আবেদনকারীকে সুবিধা পাইয়ে দিতে সব শর্ত পূরণের পরও তাদের বদলি কার্যকর হয়নি।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও ভুক্তভোগীরা এ তথ্য জানান। ডিপিই থেকে জানা যায়, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির জন্য অনলাইন আবেদন কার্যক্রম দুই ধাপে শেষ হয়।

প্রথম ধাপে শুধু নিজ নিজ উপজেলার (আন্তঃউপজেলা) মধ্যে বদলির জন্য আবেদন করার সুযোগ দেওয়া হয়। সারাদেশের প্রায় ২৫ হাজার সহকারী শিক্ষক এতে আবেদন করেন। এর মধ্যে ২৩ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে দুই হাজার আবেদন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই ২৫ হাজারের বাইরে বিভিন্ন উপজেলার এক হাজার ৩১৬টি আবেদন আটকে রেখেছেন জেলা ও উপজেলা/থানা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা। এর মধ্যে বড় আকারে হবিগঞ্জ জেলায় ২৩৭ জন, সুনামগঞ্জে ১৮৭, ভোলায় ৭৩, ময়মনসিংহে ৩০, রংপুরে ১৮, কুড়িগ্রামে ১৮, পিরোজপুরে ২৭, বড়গুনায় ২৯, নেয়াখালীতে ৩৭, ঢাকায় ৯টিসহ সারাদেশে ১৩শ ১৬ জনের আবেদন পেন্ডিং রাখা হয়েছে।

আরও পড়ুন…ফিরে দেখা বিপিএলের আট আসরের ফাইনাল

শিক্ষক বদলিতে এভাবে আবেদন আটকে রাখার নিয়ম নেই। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটানোয় গত ২ ফেব্রুয়ারি ৯৫ জন কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়। পরবর্তী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তাদের শোকজের জবাব দিতে বলা হলেও এখনো (১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) সবাই শোকজের জবাব পাঠাননি।

এমন একজন ভুক্তভোগী সাভারের বাউনিয়া আলহাজ ফিরোজ কবির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. রায়হান। তিনি বলেন, গত চার বছর আমি এ বিদ্যালয়ে কর্মরত। বদলি হওয়ার সব শর্ত পূরণ হওয়ায় গত ৪ জানুয়ারি আমার বাড়ির পাশের একটি বিদ্যালয়ে বদলির জন্য আবেদন করি।

আমি সিনিয়র হওয়ার পরও সেখানে আমাকে না দিয়ে নতুন যোগদান করা জুনিয়র একজন শিক্ষকের সেখানে দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি তারও বাড়ির পাশে। আর আমার আবেদন বাতিল না করে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

আরও পড়ুন…হাতিয়াতে ১০০ মণ জাটকা জব্দ

তিনি বলেন, আমার আবেদন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে- এমন খবর পেয়ে সাভারের উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এখন কিছু করার নেই, আগে যোগাযোগ করলে বিবেচনা করে দেখা যেত। পরে আমি অধিদপ্তরে অনেক স্যারের কাছে গেলেও হয়রানি ছাড়া কোনো লাভ হয়নি।

নিয়ম অনুযায়ী এই শিক্ষকের বদলি হওয়ার কথা ছিল। এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ আছে তাদের মতো এমন অনেকের আবেদন ঝুলে আছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও অধিদপ্তরের বড় কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি।

ডিজিটাল পদ্ধতিতে পুরোপুরি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সব প্রক্রিয়া নিষ্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও সেখানে ব্যত্যয় ঘটেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শোকজ সেটা প্রমাণ করে।

আরও পড়ুন…কুষ্টিয়ার ডিসিকে ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ: হাইকোর্ট

সর্বোচ্চ আবেদন আটকে রাখা হবিগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. গোলাম মওলার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আটকে থাকা প্রার্থীদের অধিকাংশের আবেদন অসম্পন্ন ছিল।

আবেদনের সঙ্গে তারা প্রয়োজনীয় কাগজ দেননি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা দেবে দেবে বলে পরে আর না দেওয়ায় কিছু পেন্ডিং হয়ে যায়।

আরও পড়ুন…জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতার সাথে কাজ করার আহ্বান রাষ্ট্রপতির

তিনি বলেন, আবেদন অনুমোদনের জন্য তিন থেকে পাঁচদিন সময় থাকায় এ সময়ের মধ্যে সব আবেদন দেখা সম্ভব হয়নি বলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমি অধিদপ্তরে বিষয়টি জানিয়েছি। এসব আবেদনের জন্য নতুন করে আবারও সময় দেওয়া হবে।

প্রাথমিকের শিক্ষক বদলি নীতিমালায় দেখা যায়, একজন শিক্ষক প্রথমে অনলাইনে বদলির আবেদন করলে তা প্রাথমিকভাবে যাচাই করবেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনিও আবেদনটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে যাচাই করে পাঠাবেন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে।

আরও পড়ুন…মোটরসাইকেলের ধাক্কায় দাদির সঙ্গে প্রাণ গেলো নাতনির

তিনি সেটি যাচাই করে পাঠাবেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার (ডিপিইও) কাছে। ডিপিইও সেটি মঞ্জুর করে পাঠিয়ে দেবেন আবার উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি বদলির বিষয়ে আদেশ জারি করবেন। এরপর শিক্ষক বদলির বিষয়টি অনলাইনেই জেনে যাবেন।

তিন ধাপের এই যাচাইয়ে প্রত্যেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তিনদিন করে সময় পাবেন। এই তিনদিনের মধ্যে যাচাই করে নিষ্পত্তি না করলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যাচাইয়ের জন্য নিয়োজিত পরবর্তী ব্যক্তির কাছে চলে যাবে।

অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, যে সব মাঠ কর্মকর্তা শিক্ষকদের আবেদন আটকে রেখেছেন তাদের গত ২ ফেব্রুয়ারি শোকজ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ৪৬ জন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ৪৯ জন উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা রয়েছেন।

আরও পড়ুন…২ লাখ শিশুকে ভিটামিন এ প্লাস ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে

তাদের পরবর্তী তিন কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হলেও গত ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২ জেলা থেকে শোকজের জবাব পাঠানো হয়েছে।

অধিকাংশ জবাবে সার্ভার জটিলতা, ইন্টারনেট সমস্যা, মূল্যায়নে স্বল্প সময় দেওয়া, অসম্পন্ন আবেদন পাঠানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। অনলাইন বদলির পদ্ধতি বুঝতে না পারার কারণও উল্লেখ করেছেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন…জনপ্রতিনিধিদের আন্তরিকতার সাথে কাজ করার আহ্বান রাষ্ট্রপতির

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, গত বছরের ২২ ডিসেম্বর অনলাইনে শিক্ষক বদলির সংশোধিত নীতিমালা জারি করা হয়।

তার আলোকে সফটওয়্যারের মধ্যেমে আন্তঃউপজেলার আবেদন কাজ শেষ করে। সেখানে ২৫ হাজার আবেদন পড়লে ২৩ হাজার আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। বাতিল করা হয়েছে বাকি দুই হাজার আবেদন।

আরও পড়ুন…নির্বাচনে আ. লীগের মনোনয়ন পেলেন যারা

তিনি বলেন, দ্বিতীয় ধাপে আন্তঃজেলা, আন্তঃসিটি করপোরেশন এবং আন্তঃবিভাগ পর্যায়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলি কার্যক্রম শুরু হবে। আবেদন গ্রহণ কার্যক্রম শুরু করা হবে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে। তবে মাঠ কর্মকর্তার মাধ্যমে আবেদন আটকে রাখার বিষয়টি আমার জানা নেই। ডিপিই মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, যে সব মাঠ কর্মকর্তারা শিক্ষকদের বদলি আবেদন আটকে রেখেছিলেন তাদের কাছে কারণ জানতে শোকজ দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন…নোয়াখালীতে শিক্ষকের হাত-পা ভেঙ্গে দিল দুর্বৃত্তরা

যাদের কাছে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে না তাদের দ্বিতীয় দফায় শোকজ দেওয়া হবে। কোনো কর্মকর্তা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে শিক্ষক বদলি কার্যক্রম প্রথম ধাপে শুরু হয়েছে। এটি কেউ কেউ না বুঝে আবেদন আটকে রেখেছিলেন। যারা অনিচ্ছাকৃত এ ধরনের কাজ করেছে তাদের সাধারণভাবে ক্ষমা করে দেওয়া হতে পারে।

আরও পড়ুন…তিন বড় তারকা নিয়েও রক্ষা পেলো না পিএসজি

তবে অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষকদের বদলি আবেদন কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃতভাবে আটকে রেখেছেন প্রমাণ পাওয়া গেলে ও তাদের পাঠানো শোকজের জবাব সন্তোষজনক না হলে তাদের সর্তক করে দেওয়া হবে। বদলির জন্য কেউ আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন এমন প্রমাণ পাওয়া গেলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ইবাংলা/ জেএন/১৬ ফেব্রুয়ারি , ২০২৩

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.

Contact Us