৬ জিকিরের অবিশ্বাস্য ফজিলত

জিকির বা আল্লাহর স্মরণ মুমিনের গুণ। কেননা আল্লাহ তাআলা বান্দাদের সর্বাবস্থায় অধিকহারে তাঁর জিকির করার নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো এবং সকাল সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করো। (সুরা আহজাব: ৪১-৪২) আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে যাতে সফলতা অর্জন করো।’ (সুরা আনফাল: ৪৫)

আল্লাহর জিকিরকে বলা হয় সব ইবাদতের রুহ। যারা আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল তাদেরকে মৃতব্যক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন নবীজি (স.)। আবু মুসা আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘যারা আল্লাহর জিকির করে এবং যারা আল্লাহর জিকির করে না, তাদের দৃষ্টান্ত জীবিত ও মৃত ব্যক্তির মতো।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪০৭)

পবিত্র কোরআনে জিকিরবিমুখ ব্যক্তি সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আমার স্মরণে বিমুখ থাকবে, অবশ্যই তার জীবনযাপন হবে সংকুচিত। আর তাকে কেয়ামতের দিন উঠাব অন্ধ করে।’ (সুরা ত্বহা: ১২৪)

আরও পড়ুন>> ফজরে ঘুম থেকে না উঠতে পারার কারণ ও উঠার উপায়

মুহাদ্দিসরা বলেন, আল্লাহর যেকোনো ধরনের আনুগত্য ও ইবাদত, আল্লাহর নাম ও তাঁর গুণাবলির উচ্চারণ, কোরআন তেলাওয়াত ও ধর্মীয় আলোচনাগুলো আল্লাহর স্মরণের অন্তর্ভুক্ত। তবে সাধক আলেমরা তাঁদের অনুসারীদের অবস্থা বিবেচনায় বিশেষ জিকির ও তাসবিহ পাঠের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কোরআন ও হাদিসে বর্ণিত এসব তাসবিহ জিকির হিসেবে গণ্য।

নিচে অবিশ্বাস্য ফজিলতপূর্ণ ৬টি জিকির তুলে ধরা হলো। যেসব জিকিরের পুরস্কারস্বরূপ দুনিয়া-আখেরাতে অনেক কল্যাণ নীহিত রয়েছে।

ইস্তেগফার
গুনাহ মাফ ছাড়াও ইস্তেগফারের কিছু বিস্ময়কর উপকার রয়েছে। যেমন—বিপদ ও দুশ্চিন্তা দূর হওয়া, রিজিক ও সন্তান-সন্ততিতে বরকত আসা, মুমিনের দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার পেছনেও ইস্তেগফারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তেগফার করবে, আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। (মুস্তাদরাকে হাকেম: ৭৬৭৭)

দরুদ
আল্লাহ তাআলা দরুদ পাঠ করার নির্দেশ দিযে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা নবীর ওপর দরুদ পাঠান, হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরাও নবীর ওপর দরুদ পাঠাতে থাকো এবং উত্তম অভিবাদন (সালাম) পেশ করো।’ (সুরা আহজাব: ৫৬)
আল্লাহ তাআলার এই নির্দেশ একদিকে যেমন আল্লাহর কাছে তাঁর রাসুলের মর্যাদার প্রমাণ অন্যদিকে মুমিন বান্দার রহমত, বরকত ও অবারিত কল্যাণ লাভের অন্যতম উপায়। একজন মুমিনের সকল মাকসুদ লাভ হয় দরুদে। উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (স.) আল্লাহর জিকিরের খুব তাকিদ করলেন। আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে থাকি। আমি আমার দোয়ার কতভাগ আপনার জন্য নির্ধারণ করব? তিনি বললেন, তোমার যে পরিমাণ ইচ্ছা। আমি বললাম, চারভাগের এক ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে অর্ধেক? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা। তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে তিন ভাগের দুই ভাগ? তিনি বললেন, তোমার যতটুকু ইচ্ছা হয়। তবে বেশি করলে আরো ভালো। আমি বললাম, তাহলে কি আমার দোয়ার পুরোটাই হবে আপনার প্রতি দরূদ? তিনি বললেন, তবে তো তোমার মকসুদ হাসিল হবে, তোমার গুনাহ মাফ করা হবে।’ (তিরমিজি: ২/৭২; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ১০/২৪৮; মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৬/৪৫)

আরও পড়ুন>> স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন ১০ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান

৪ তাসবিহ
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি ১০০ বার করে ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবর’ ও ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়বে, সেদিন তার চেয়ে বেশি সওয়াব কেউ আল্লাহর দরবারে পাঠাতে পারবে না। ওই ব্যক্তি ছাড়া যে তার মতো ওই জিকিরগুলো করেছে। উম্মু হানি (রা.) রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি বুড়ো ও দুর্বল হয়ে গেছি। আমাকে এমন একটি আমল শিখিয়ে দিন, যা আমি বসে বসে পালন করতে পারব। তিনি বললেন, তুমি ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে, তাহলে ১০০টি ক্রীতদাস মুক্ত করার সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। ১০০ বার ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলবে, তাহলে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের জন্য ১০০টি সাজানো ঘোড়ায় মুজাহিদ পাঠানোর সমপরিমাণ সওয়াব তুমি পাবে। ১০০ বার ‘আল্লাহু আকবর’ বলবে, তাহলে ১০০টি মাকবুল উট কোরবানির সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। তুমি ১০০ বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, তাহলে তোমার সওয়াবে আসমান ও জমিন পূর্ণ হয়ে যাবে (এবং তোমার কোনো পাপই বাকি থাকবে না: দ্বিতীয় বর্ণনায়)। যে ব্যক্তি তোমার এ জিকিরগুলোর সমপরিমাণ জিকির করবে, সে ছাড়া কেউই সে দিনে তোমার চেয়ে বেশি বা উত্তম আমল আল্লাহর দরবারে পাঠাতে পারবে না।’ হাদিসটি বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং সনদগুলো হাসান বা গ্রহণযোগ্য। (ইবনে মাজাহ: ২/১২৫২; মুসনাদে আহমদ: ৬/৩৪৪; নাসায়ি, আস-সুনানুল কুবরা: ৬/২১১; তাবারানি, আল মুজামুল কাবির: ২৪/৪১০; মুসতাদরাক হাকিম: ১/৬৯৫)

বিশেষ তাসবিহ
হাদিসে একটি জিকিরের বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জিকিরটি হলো—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদু ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাইয়িন ক্বদীর’। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন ১০০ বার উক্ত কালেমাটি বলবে, সে ১০টি গোলাম আজাদ করার সমান সওয়াব লাভ করবে, তার নামে ১০০টি সওয়াব লেখা হবে ও তার আমলনামা হতে ১০০ গুনাহ মুছে ফেলা হবে। আর সে সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তানের ধোঁকা থেকে মুক্ত থাকবে। কেয়ামতের দিন কেউ তার থেকে ভালো আমল আনতে পারবে না, একমাত্র সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে তার থেকে বেশি নেক আমল করেছে।’ (বুখারি: ৬০৪০)

আরও পড়ুন>> মৃত স্ত্রীকে দেখা কি নাজায়েজ?

দোয়া ইউনুস
দোয়া ইউনুস-এর ফজিলত ও গুরুত্ব অনেক বেশি। যে কোনো বিপদ-মসিবত, দুশ্চিন্তা-পেরেশানি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে দোয়া ইউনুস পাঠ করা অত্যন্ত কার্যকর আমল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তখন আমি তার (ইউনুসের) ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা থেকে উদ্ধার করেছিলাম। আর এভাবেই আমি মুমিনদের নাজাত দিয়ে থাকি।’ (সুরা আম্বিয়া: ৮৮)
দোয়া ইউনুস হলো— لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ ‘লা ইলাহা ইল্লা আংতা, সুবহানাকা ইন্নি কুংতু মিনাজ জ্বলিমিন।’ অর্থ: ‘তুমি ছাড়া সত্য কোনো উপাস্য নেই; তুমি পুতঃপবিত্র, নিশ্চয় আমি জালিমদের দলভুক্ত।’

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, আমি তোমাদের এমন বিষয়ের সংবাদ দেবো যে তোমাদের কারো ওপর যখন দুনিয়াবি কোনো কষ্ট-ক্লেশ অথবা বালা-মসিবত নাজিল হয়, তখন তার মাধ্যমে দোয়া করলে তা দূরীভূত হয়। তা হলো ইউনুস (আ.)-এর দোয়া—‘লা ইলা-হা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জলেমিন।’ (সহিহুল জামে: ২৬০৫)
বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে, দৈনিক এক হাজার বার দোয়া ইউনুস পড়লে পদমর্যাদা সমুন্নত হয়। আল্লাহ তার রুজি-রোজগারে সমৃদ্ধি দান করেন। দুঃখ-যন্ত্রণা, পেরেশানি, অশান্তি ও কষ্ট-প্রভৃতি দূর করেন। তার জন্য সব রকম কল্যাণের দ্বার খুলে দেন। শয়তানের প্ররোচনা থেকে তাকে রক্ষা করেন।

এই দোয়াটি এক লাখ পঁচিশ হাজার বার পড়লে (যেটা খতমে ইউনুস হিসেবে পরিচিত) সব ধরনের অপকার থেকে রক্ষা, বিপদ-আপদ থেকে দূরে থাকা এবং রোগ-শোক থেকে রক্ষা পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে।

আরও পড়ুন>> কিডনি ভালো রাখবে এই ঘরোয়া পদ্ধতিগুলো

আল্লাহর গুণবাচক নামের জিকির
আল্লাহর গুণবাচক নামের জিকির করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে কোরআন ও হাদিসে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম। অতএব তোমরা তাঁকে সেইসব নামেই ডাকবে..।’ (সুরা আরাফ: ১৮০) এর বিস্ময়কর উপকার রয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলার নিরানব্বই নাম আছে, এক কম একশত নাম। যে ব্যক্তি এ (নাম) গুলোর হেফাজত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ বিজোড়। তিনি বিজোড় পছন্দ করেন।’ (সহিহ বুখারি: ৬৪১০)

মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হলো ذُو الْجَلَالِ وَالْاِكْرَامِ ‘জুল জালালি ওয়াল ইকরাম’। এই নামের দুটি অংশ। প্রথম অংশ জুল জালাল অর্থ হলো- ‘সমস্ত সৃষ্টি জগতের অধিপতি; যিনি সৃষ্টিকুল থেকে ভয় পাওয়ার হকদার ও একমাত্র প্রশংসার যোগ্য; দ্বিতীয় অংশের অর্থ হলো- মহত্ব-বড়ত্ব-দয়া ও ইহসানের অধিকারী’। যেকোনো কাজ সুন্দরভাবে শেষ করার জন্য, কাজের ভালো ফলাফলের জন্য এবং দুনিয়ার ধন-দৌলত ও রিজিকের প্রশস্ততার জন্য এই নামের বেশি বেশি জিকির করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। কেননা এই জিকিরের মাধ্যমে একসঙ্গে দুটি কাজ হয়। ১) মহামহিম আল্লাহর উচ্চমর্যাদার গুণকীর্তন ২) দয়াবান আল্লাহর দয়ার ভিখারি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে উল্লেখিত জিকিরগুলো নিয়মিত পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

ইবাংলা/এসআরএস

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.

Contact Us