গত রাতে জবি ক্যাম্পাসে আড্ডা দিচ্ছিলাম জবি’র দুই জন রিপোর্টারের সাথে ।হঠাৎ একজন বললো ভাই তেলের দাম বেড়ে গেছে। শুনেই পেট্রোল পাম্পে তেল ফুরাতে গিয়ে, না পেয়ে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে বাসায় এসে লিখতে লাগলাম তেল নিয়ে তেলেসমাতি। রাত ১২ টায় বাসায় এসে টিভি আর পত্রিকার পাতায় দেখি রীতিমতো তেল নিয়ে লঙ্কাকান্ড।
সভ্যতার অগ্রগতি চাকা আবিস্কারের মধ্য দিয়ে । সেই চাকাকে সচল রাখতে ব্যবহৃত হয় জ্বালানি তেল পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, কেরোসিন ইত্যাদি। একটি দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে যে তেলের ওপর আমাদের বেচে থাকা সেই তেল নিয়েই কেন এতো তেলেসমাতি?
৫ আগস্ট শুক্রবার রাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এখন থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ৮০ টাকা থেকে বেড়ে ১১৪ টাকা , পেট্রলের নতুন দাম লিটারে ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম লিটার ৮৯ টাকা থেকে বেড়ে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হবে।
আরোও পড়ুন…দেশের বাজারে যোগান দিতে কাঁচামরিচ আমদানি
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের উর্ধ্বগতির বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা বাধ্য হয়েই দাম কিছুটা সমন্বয়ে যেতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ২০১৬ সালের মত জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়।
উল্লেখ্য ভারত ২২ মে ২০২২ তারিখ থেকে কলকাতায় ডিজেলের মূল্য প্রতি লিটার ১১৪ টাকা এবং পেট্রোল লিটার প্রতি ১৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে। এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন – নেপালে ডিজেল ১২৭ টাকা, ইন্দোনেশিয়া ১৩৮, সিঙ্গাপুর ১৮৯ টাকা, চীন ১১৮ টাকা, আরব আমিরাত ১২২.৮০ টাকা ও হংকং এ ২৬০ টাকা।
বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। ভারতে মূল্য কম থাকায় তেল পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকেও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।। এ পদ্ধতি দেখে মনে হচ্ছে এ দেশে প্রশাসনের চেয়ে চোরাকারবারিদের শক্তি বেশি।
উন্নয়নের মূল কথাই হলো, যত বেশি জ্বালানি, তত বেশি বিদ্যুৎ , তত বেশি বিনিয়োগ , তত বেশি কর্মসংস্থান, বেকারত্বের অবসান, উৎপাদন উন্নয়ন, সর্বোপরি জাতীয় প্রবৃদ্ধি। করোনা ও বৈশ্বিক যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক ধীরগতি, কর্মসংস্থানহীনতা, দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি এই নির্দেশনা দেয় যে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি স্থবিরতা মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলবে।
ঊর্ধ্বমুখী নিত্যপণ্যের দামে সঙ্গে জ্বালানী তেলের অস্বাভাবিক ম্যুল্য বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকটে নিত্যপণ্যের দামে সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঠিক সে সময়ে এলো বড় দুঃসংবাদ। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়বে বাস, ট্রাক, কভার্ডভ্যানের ভাড়ায়। লঞ্চসহ নৌযানের ভাড়াও বাড়বে। আর এর পরোক্ষ প্রভাব পড়বে বহু খাতে।
ট্রাক কিংবা নৌযানের ভাড়া বেড়ে গেলে শাক-সবজি থেকে শুরু করে যে সব পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে বাজারে আসে, তার সবের দাম বাড়বে। ফলে দেশের সব পরিবারেরই মাসিক খরচের হিসাব নতুন করে সাজাতে হবে।জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে নতুন করে বাস, লঞ্চ ও ট্রাকভাড়া বাড়বে। প্রাইভেট কারের মালিক ও মোটরসাইকেলের চালকদের খরচও বাড়বে। ব্যয় বাড়বে কৃষি খাতে, যা বাড়িয়ে দেবে পণ্যের দাম।
ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বা জেনারেটর চালানোর খরচ বেড়ে যাবে, দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শিল্পেও ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আঁচ পড়বে।মাছ ধরা ট্রলারগুলোরও জ্বালানি ডিজেল, তাই সেখানেও খরচ বাড়বে। কৃষিক্ষেত্রে সেচ পাম্প ও পাওয়ার টিলারে ডিজেলে ব্যবহার হয় বলে কৃষকেরও ব্যয় বাড়বে।
বাজারে এখন চাল, ডাল, তেল, চিনি, সাবান, টুথপেস্টসহ প্রায় সব পণ্যের দাম বেশি। গত মে মাসের পর ডলারের দাম ৮৬ থেকে ১০৮ টাকায় উঠে যাওয়ায় আমদানি করা সব পণ্যের দাম বাড়ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানী তেলের অস্বাভাবিক মুল্য বৃদ্ধির জন্য আরও চাপে পড়বে আগে থেকেই দ্রব্যমূল্যের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা সাধারণ মানুষের জীবন।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সরকার আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে তাদের শর্ত হিসাবে জ্বালানীতে ভর্তুকি কমাতে তেলের দাম বাড়িয়েছে।
অতীত কাল থেকে এই পৃথিবীতে জ্বালানি তেল বিক্রি, পরিবহন, সংরক্ষণ এবং তেলের ব্যবহারকারীদের যে সিন্ডিকেট রয়েছে তা সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে নেই। এই দেশে যেখানে বঙ্গবন্ধুর কম্বল চুরি করতে পারে লুটেরা, সেখানে তেল চুরি স্বাভাবিক ঘটনা।এই দেশের তেলের পাইপলাইন, তেলের লরি, ট্রাক এবং ট্যাঙ্কার থেকে যেভাবে তেল চুরি হয় সেভাবে আফ্রিকার দরিদ্র ও অপরাধপ্রবণ কোনো দেশেও হয় না। তেলে ভেজাল মেশানো এবং ওজনে কম দেয়ার পরিসংখ্যান গণনা করা হলে আমরা যে এভারেস্টের চূড়ায় থাকব তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অন্য দিকে তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে পুঁজি করে এ দেশের পরিবহন মালিকরা যেভাবে ভাড়া বাড়িয়ে নেয় তাতে মনে হয় সরকারের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত তাদের জন্য আলা উদ্দিননের চেরাগ হাতে পাওয়া। ফলে দেশের খেটে খাওয়া প্রান্তিক জনগণের ঘাম-শ্রম এবং রক্ত প্রতিদিন তেল সিন্ডিকেটের হোতাদের শরীরে যে পরিমাণ চর্বি পয়দা করে সেই চর্বি পোড়ানোর আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে তেল সিন্ডিকেটের রুই-কাতলা ও রাঘববোয়ালদের পুঞ্জীভূত চর্বিকে দগ্ধ করতে হবে।
ছোট বেলায় পাটি গণিতের অংকের মত – চালের দাম ২৫% বাড়লে চালের ব্যবহার কত % কমালে ব্যয় অপরিবর্তিত থাকবে? উত্তর হলো- ২০%। ঠিক তেমনি এখন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেলের ব্যবহার কমানো ও অপচয় রোধ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় আছে কি?
জ্বালানি তেলের উপর থেকে নির্ভরতা কমানোর জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি পরিহার করে পাবলিক বাসকে জনপ্রিয় করতে হবে। অফিস আদালতের জন্য কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়িকে নিরুৎসাহিত করে অফিস বাসকে উৎসাহিত করতে হবে। স্কুল বাস চালু করার উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। মোটরসাইকেল পরিহার করে পরিবেশ বান্ধব বাইসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে।
এই যুগে তেল ছাড়া সবকিছু অচল। তেল ছাড়া বাতি জ্বলে না, গাড়ি চলে না, বিমান ওড়ে না, উনুন জ্বলে না, জীবনও চলে না। তেল বেঁচে থাকবার অনিবার্য উপাদান, জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তেল আছে বলে জীবন আছে। তেল ফুরিয়ে গেলে জীবনপ্রদীপও নিভে যাবে।
সরকারের কথা মতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থামাতে তেলার দাম বৃদ্ধির সময় তাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ তেলের অপচয় রোধ করে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করাই বেচে থাকার একমাত্র সমাধান।
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লেখক – তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।
সভাপতি – সিএসই এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ইবাংলা/আরএস/৬ আগস্ট,২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.