বেশ কিছু দিন থেকে বিশ্ব ব্যবস্থা রাজনৈতিক ভাবে উত্তপ্ত। সেই রাজনৈতিক উত্তপ্ত আজকে অর্থনৈতিক উত্তাপে রুপ নিয়েছে। ইউক্রেন -রাশিয়া যুদ্ধ, তাইওয়ানে চায়নার এক নীতির আগ্রাসন অন্যদিকে দীর্ঘদিন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য দ্রব্যের সংকট ও বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে।
পরাশক্তিদের অর্থনৈতিক যুদ্ধের কাছে যেন তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো আজ অসহায়। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পেলেও উন্নয়নশীল দেশে জ্বালানি সঙ্কট তৈরি হচ্ছে ফলে দেশগুলো তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করছে।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে পণ্য পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এভাবেই সামগ্রিকভাবে দিনদিন মূল্যস্ফীতি হচ্ছে।
গণপরিবহণের ভাড়া বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে যাত্রীদের ভোগান্তির মাত্রাও চরমে উঠেছে। অন্যদিকে আয় না বাড়লেও সব শ্রেণির মানুষের ব্যয় হু হু করে বাড়ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে অসহনীয় দুর্ভোগে পড়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের পরিবার।
আরও পড়ুন…হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপের ৯টি গ্রাম প্লাবিত
বাংলাদেশের বেশ কিছুদিন ধরে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক সময় অসাধু ব্যবসায়ী ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। সরকার ভোজ্য তেলের সংকট কাটিয়ে উঠতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও তেলের দাম কমানো সরকারের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আবারো ভোজ্য তেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি শোনা যাচ্ছে।
অধিকাংশ পরিবার চাহিদা থাকলেও ব্যয় কমাতে পণ্য ও সেবা কেনার ক্ষেত্রে বাজেট কাটছাঁট করছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন খরচ চালাচ্ছে। মুলত: জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে নিত্যপণ্যের দাম অসহনীয় হয়ে উঠছে।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দূরপাল্লার বাসের পাশাপাশি রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলাতে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সব শ্রেণির মানুষ দুর্ভোগে পড়তে শুরু করেছে।
বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে। তাদের নাভিশ্বাস বাড়ছে। তাই এই সংকট মোকাবিলায় সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
আগে উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রাকে ১৫-১৬ হাজার টাকায় সবজি আনা যেত। তেলের দাম বাড়ায় ১৯-২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে ট্রাকপ্রতি ৩ হাজার টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। তাই সবজির দাম বেড়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলের কাঁচাবাজার ও মুদি দোকানে নিত্যপণ্যের দাম ও বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে প্রতি কেজি চালের দাম ৫ টাকা বেড়েছে। প্রতি কেজি আটা ময়দায় ৪ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১৫ টাকা, চিনি ৩ টাকা বেড়েছে। এ ছাড়া প্রতি কেজি সবজি সর্বোচ্চ ২০ টাকা বেড়েছে। আর মাছ কেজিতে বেড়েছে ১০ থেকে ৪০ টাকা।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি খোলা আটা বিক্রি হয়েছে ৪৬ টাকা, যা দুদিন আগে ৪২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি খোলা ময়দা বিক্রি হয়েছে ৬২ টাকা, যা আগে ৫৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে চিনি বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৭৫ টাকা, যা আগে ১৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। চার টাকা বেড়ে প্রতি হালি ফার্মের ডিম বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকা।
বাজারে প্রতি কেজি রুইমাছ ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৩১০ টাকা ছিল। ১০ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি পাঙাশ ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৭২-৭৫ টাকা, যা তেলের দাম বৃদ্ধির আগে ৬৮-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রতি কেজি বেগুন ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৬০ টাকা ছিল। ঢেঁড়শ ৩৫ টাকা বিক্রি হলেও সোমবার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হওয়া শসা বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা।
এছাড়া খুচরা বাজারে বিআর ২৮ জাতের চাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৫৫ টাকায়, যা তেলের দাম বাড়ার আগে ৫০ টাকা ছিল। এ ছাড়া মোটা জাতের চালের মধ্যে স্বর্ণা চাল বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা, যা আগে ৪৬ টাকা ছিল।
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে প্রতি কেজি পটোল ৩৫ টাকা বিক্রি হলেও সোমবার ৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাঁচ টাকা বেড়ে এক কেজি পেঁপে বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে চিচিঙা, ধুন্দল, কাঁকরোল বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়।
তাই আগের কিছু টাকা সঞ্চয় করলেও এখন করা যাচ্ছে না। বরং আগের কিছু সঞ্চয় করা টাকা ভেঙে সংসার চালাতে হচ্ছে।
সরকার বিভিন্ন সময় জিনিসের দাম বৃদ্ধি করে, ফলে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ে। কিন্তু আমাদের আয় বাড়ে না। একজন শ্রমিকের ৩৫০- ৪৫০ টাকার কাজ করতে হয়।এ দিয়ে সংসারের অন্যান্য খরচসহ পরিবারের ৫-৬ সদস্যের খাবার নিতে হয়।
আরও পড়ুন…বাংলাদেশ জ্বালানি মজুতকরণ সক্ষমতার যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে
ইতোমধ্যে বাজারে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এতে সব শ্রেণির ভোক্তা বিড়ম্বনায় পড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বেশি বেড়েছে। এক কর্মশালায় কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এখন তেলে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিলে রিজার্ভ একদম কমে যাবে।
এতে দেশ হুমকির মুখে পড়ে যাবে। এর চেয়ে বরং এখনই কিছুটা কষ্ট করে আমরা সাবধান হই। আমরা একটু সাশ্রয় করি, একটু কম খাই। তিনি জানান, সরকার ইচ্ছা করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায়নি। রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে তেলের দাম বেড়েছে। তাই দেশের তেলের দাম সমন্বয় করতে হয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে যাতে অসাধুরা পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়াতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক থাকে সেজন্য তদারকি করা হচ্ছে। কেউ পণ্যের দাম নিয়ে কারসাজি করলে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে।
জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে তেল, চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুনসহ একাধিক পণ্যের দাম বেড়েছে।
মিরপুরের চালের আড়ৎ ঘুরে জানা যায় কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার অটো রাইস মিল থেকে চাউল আসা ট্রাকের প্রতি বস্তায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। নাজিরশাইল চাল ইতোমধ্যে ৭৫-৮০ টাকা হয়েছে, যা সামনে আরও বাড়বে।
বাজারে চাল, আটা, চিনি, কাঁচামরিচ, সুকনা মরিচ, বিভিন্ন মসলা, মাছ, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বেড়েছে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি চাষের কই মাছ আগে ছিল ১৫০ টাকা, সোমবার ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, চাষের শিং মাছ আগে ছিল ২৫০ টাকা, এ দিন বিক্রি হয়েছে ৩৫০ টাকা কেজি।
বাজারে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খেটে-খাওয়া মানুষ ভিড় করছে এলাকার ওএমএসের দোকানগুলোতে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাঁচা শাকসবজি, মাছ-মাংস অন্যান্য জিনিস গুলো কাচাঁবাজার থেকে কিনতে হয় কিন্তু আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্রমেই সেই ক্রয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
ইবাংলা/জেএন/১৩ আগস্ট,২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.