এবার আগস্ট এসেছে করোনা মহামারী পরবর্তী অকারণ অযৌক্তিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার রণে টাল-মাটাল পৃথিবীতে যুগপৎ শোক ও শক্তির বারতা নিয়ে। রাশিয়া, ইউক্রেন, আমেরিকার রণকৃত্যে তীব্র জ্বালানী সংকটে সন্ত্রস্ত সময়ে আগস্টের পদধ্বনি স্মরণ করিয়ে দে সেই দুঃসহ বেদনার কথা। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য, নৃশংসতম, অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাযজ্ঞের কালিমালিপ্ত বেদনাবিধূর শোকের দিন ১৫ই আগস্ট।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে শ্রাবণ নাকি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের তাজা রক্ত ও আসমানের বাঁধনহারা অশ্রুতে! আজও আগস্ট এলে যে বৃষ্টি ঝরে তা যেন পিতাকে হারানোর বেদনায় কাল থেকে কালান্তর চলমান ক্রন্দন। সেই ক্রন্দনের প্রতিটি ফোটা হোক সংকট উত্তরণে কাপ্তাইয়ের জল বিদ্যুতের মতো শক্তি।
আরও পড়ুন…সারের মজুত পর্যাপ্ত, বেশি দামে বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা:কৃষিমন্ত্রী
সেদিনের বীভৎসতা ছিলো রীতিমত রক্তগঙ্গার মত। অর্থাৎ মাংস, রক্ত, মগজ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রতিটি ফ্লোরের দেয়ালে , জানালার কাঁচে, মেঝে ও ছাদে।চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের সব তৈজসপত্র। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল । প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে ছিলো ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়কের রক্তাক্ত লাশ ।
হায়েনারা তলপেট ও বুক বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল । নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙ্গা চশমা ও অতি প্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কক্ষে শেখ কামাল, মাস্টার বেডের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজি জামাল, নিচতলার বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল অতি আদরের ছোট্টশিশু শেখ রাসেলের লাশ।” এই রকম ভয়াল ও নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
১৫ই আগস্টের হত্যা কেবল একজন বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের খুন নয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিলো দেশ ও জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। এই বর্বরোচিত হত্যায় পরিকল্পনাকারী, হত্যাকারী এবং বেনিফিশিয়ারি তিন পক্ষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো।
দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে তারা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে দৈহিক হত্যা করতে পারলেও বাঙালি জাতির চেতনার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারেনি, তাকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে পারেনি এমনকি বঙ্গবন্ধুর সংগ্রাম ও সাফল্যের ইতিহাসকে ম্লান করতেও পারেনি । কারণ, বাঙ্গালী ইতিহাসের মহাকাব্যের মহানায়ক হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘মোর লাগি করিয়ো না শোক, আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক’। এই চরণদ্বয় বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে যথার্থ সত্য। বঙ্গবন্ধুর কর্ম এখনো রয়েছে বাংলা ও বাঙালির জীবনালোকে সর্বত্র । তাই শুধুমাত্র শোকের মাতন না করে তাঁর রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য তার আদর্শের আলোকে জীবন গড়ে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুঁটানোর প্রতিজ্ঞাই হোক তাঁর রক্তের ঋণ শোধ করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম।
মাত্র ৫৫ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত, নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা ইতিহাসে বিরল। সেই প্রেক্ষিতেই তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুটো শিবিরে বিভক্ত- শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’শুধু তাই না, প্লেটোর রিপাবলিক গ্রন্থের প্রকৃত নেতার সব গুনের সমাবেশ ঘটেছিল ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষের মধ্যে ।
যিনি তার ৭ই মার্চের জাদুর কন্ঠ ও তর্জনীতে রচনা করেছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস। এত কিছুর পরও ৭৫এর ১৫ই আগস্টের কালিমাময় দিনে ঘাতকের নির্মম বুলেটে জাতি হারিয়েছে তার গর্ব, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু কে। তাই শোক দিবসে সারাদেশের পথে-প্রান্তরে লাখো-কোটি কৃতজ্ঞ বাঙালীর কণ্ঠে ধ্বনিত হবে অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিমালা- “যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”
বঙ্গবন্ধ কেমন ছিলেন নবীন প্রজন্মের উত্তরে বলতে হয় – ফাঁসির কাষ্ঠেও যিনি আপোস করেননি স্বাধীনতার প্রশ্নে, ১৫ই আগস্ট কালরাতে ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও যিনি ছিলেন অকুতোভয়, প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?- সেই অনির্বাণ সূর্যের প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তাঁর আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না।
আরও পড়ুন…বঙ্গবন্ধু হত্যার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী জিয়া ও তার পরিবার:তথ্যমন্ত্রী
আসলে ঘাতকরা ভুলেই গিয়েছিল জীবিত মুজিব থেকে মৃত মুজিব বেশি শক্তিশালী। প্রকৃতপক্ষে, বঙ্গবন্ধু কোন ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। সেই আদর্শ ও দর্শনের প্রেরণায় বৈশ্বিক যেকোন সংকটে এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকীতে অবনতচিত্তে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় তিনি আরো বেশি জীবন্ত, আরো শক্তিশালী, আরো ব্যক্তিত্বময় হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। মৃত্যুর ৪৬ বছর পরে আজও তাঁর ছবি, তাঁর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ, তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা সহ বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মে তিনি জীবন্ত।
তিনি আমাদের নতুন করে জেগে ওঠার শক্তি শপথ আর সাহসের অপর নাম। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত না করতে পারার মর্মার্থ হলো আবেগহীন মাতম। তাই জাতির পিতাকে হারানোর এই দিনে সকলের শপথ হোক- শুধুমাত্র আবেগহীন মাতন নয় বরং শোককে শক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, দূরদৃষ্টি, আদর্শ ও স্বপ্নকে অন্তরে ধারণ ও বরণের আলোকে বাঙালির উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত হয়ে সকল প্রাকৃতিক ও মনুষ্য সৃষ্ট সংকটে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া।
ইবাংলা/জেএন/১৪ আগস্ট,২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.