নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে ৫ সেপ্টেম্বর ৪ দিনের সরকারি সফরে ভারতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টানা ৩ বছর পর দিল্লি সফরকালে ৬ সেপ্টেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করবেন।
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা প্রাধান্য পাবে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মধ্যে দিয়ে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক আরো গভীর হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সফর সামনে রেখে উভয় পক্ষ বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি পৌঁছাবেন। সেদিন দিল্লির বাংলাদেশ দূতাবাসে ভারতীয় অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হবেন। দিল্লি সফরের দ্বিতীয় দিন ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। তবে বৈঠকের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
আরও পড়ুন…বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার জন্য লাগসই ডিজিটাল সংযোগ অপরিহার্য
আগামী ৭ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন বিকেলে আজমীর শরীফে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির মাজার জিয়ারত করবেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর জয়পুর শহর থেকে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত বছরের ২৫ মার্চ ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তিনি সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানান। এরপর গত বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতের প্রেসিডেন্ট রামনাথ কোবিন্দ ঢাকা সফর করেন। এক বছরের মধ্যেই ভারতের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী ঢাকা সফর করেছেন। ফিরতি সফর হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাচ্ছেন।
এই সফরে ভারতের কূটনৈতিক মহল এবং সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ার যে প্রবণতার কথা বলা হচ্ছে তাও পরিষ্কার করা হবে বলে জানা গেছে৷ তবে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে কথা হলেও তিস্তা নিয়ে কিছু হচ্ছে না৷ কুশিয়ারার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি হতে পারে, ভারতে যৌথ নদী কমিশনের বৃহস্পতিবার (আগস্ট) বাংলাদেশ ভারত বৈঠকে তা স্পষ্ট হয়েছে৷
২০১৯ সালের অক্টোবরে শেখ হাসিনা সর্বশেষ ভারত সফর করেন৷ এরপর ৫ সেপ্টেম্বর ভারত সফরে যাচ্ছেন তিনি৷ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে৷ তাই আগামী নির্বাচনের আগে এটাই প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ভারত সফর বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০২১ সালের মার্চে সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করেন৷
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দিক দিয়ে শেখ হাসিনার এই ভারত সফরকে গুরুত্বের সঙ্গে বিশ্লেষকেরা দেখলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সবশেষ বক্তব্যে দুই দেশের সরকারই অবশ্য কিছুটা বিব্রত৷
আরও পড়ুন…তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান
এই সফরে যেসব বিসয় আলোচনায় আসবে তার মধ্যে আছে সামরিক সরঞ্জাম কেনা৷ এনিয়ে ২০১৯ সালে চুক্তি হয় ভারতের সাথে৷ ভারত ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে৷ ওই ঋণের আওতায় ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কিনবে বাংলাদেশ৷ গত জুলাইয়ে ভারতের সেনা প্রধান যখন ঢাকা সফর করেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন৷ সাক্ষাতে বিষয়টি ওঠে বলে জানা যায়৷
মেরিটাইম সিকিউরিটির জন্য ভারত থেকে রাডার ক্রয় নিয়েও কথা হবে৷ উপ-আঞ্চলিক এনার্জি হাব গঠন নিয়ে কথা হবে৷ আর সেটা হলো বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানকে নিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প৷ এর নেতৃত্বে রয়েছে ভারত৷ বাংলাদেশ নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আনতে চায়৷ একই সঙ্গে এই অঞ্চলে জ্বালানি নিরাপত্তা কানেকটিভিটি বিষয়টি নিয়ে যৌথভাবে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ৷
এবার সফরের অর্থনেতিক বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি, সেপা (কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট)৷ এই চুক্তি হলে ভারত ও বাংলাদেশের পণ্য দুই দেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুবিধা পাবে৷ বাংলাদেশ এরইমধ্যে এই চুক্তি অনুমোদন করেছে৷ এর সঙ্গে বাংলাদেশ এন্টি ডাম্পিং নীতি নিয়েও কথা বলবে৷
এবারের সফরে বাংলাদেশ চাইছে যে দুই দেশের মধ্যে যে সর্বোচ্চ সম্পর্ক তা আরো একবার নির্বাচনের আগে প্রমাণ করা৷ আর সেজন্য বাংলাদেশের দিক দিয়ে সেপা চুক্তিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে৷ পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করা হচ্ছে৷
আর ভারতে যে একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে তা দূর করতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ শেখ হাসিনা ৫ সেপ্টেম্বর ভারত গিয়ে সেখানকার কূটনীতিকদের সঙ্গে মত বিনিময় করবেন৷ দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাস এ আয়োজন করেছে৷ মোদীর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ৬ সেপ্টেম্বর৷ দুই নেতার যৌথ ঘেষণায় সুসম্পর্কের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি ফোকাস করা হবে বলে জানা গেছে৷
কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘ভারতের বিরুদ্ধে যে বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভ এবং বাংলাদেশের চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া এর তো বাস্তব ভিত্তি আছে৷ দুই-একটি সফর দিয়ে তার অবসান হবে না৷ ভারত নানা অজুহাতে তিস্তার পানি দিচ্ছে না৷ এবারও দেবে না৷
আরও পড়ুন…বিএনপিকে দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধের দাবি পরশের
আবার সামনে নির্বাচন আসবে সেটাকে কারণ দেখিয়ে দেবে না৷ সীমান্ত হত্যা শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না৷ তার বলছে সীমান্তে অপরাধ হচ্ছে৷ পৃথিবীর সব দেশের সীমান্তেই অপরাধ হয়৷ ভারত যা চায় তা পায়, আমরা যা চাই তা পাই না৷”
এই সফরের রাজনৈকি গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে সঠিক বলে ধরে নিই তাহলে তো আর কিছু বলার নেই৷ বিষয়টা হলো ভারতের সাথে আমাদের সব সময়ই কথা হয়, আলাপ আলোচনা হয়৷ এটা তো রুটিন কাজ৷ কিন্তু অর্জন কী হয় সেটাই প্রশ্ন৷ গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি৷”
আর সাবেক এক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, নির্বাচনের আগে যেহতু এই সফর তাই স্বাভাবিক কারণেই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা তো হবেই৷ তার মতে কী আলোচনা হবে সেটা তো আর আমরা জানতে পারব না৷ কারণ রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা তো আর প্রকাশ করা হয় না৷
তিনি মনে করেন, ‘‘দুই দেশের মধ্যে সুম্পর্ক আছে কিন্তু সেই সম্পর্ক হতে হবে সমতার ভিত্তিতে৷ দেনা পাওনার হিসেবে ধরলে আমরা কম পাচ্ছি৷ ভারতকে আমরা যেরকম সুযোগ সুবিধা দিই৷ আমরাও তো সেরকম সুযোগ সুবিধা চাই৷ আর এটা সুষম হতে হবে৷”
হুমায়ন কবিরের মতে, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি আছে৷ নানা রকম শুল্ক এবং অশুল্ক বাধার মুখে পড়ে আমাদের পণ্য৷ সেটা হলে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে দুই দেশের পণ্য৷ কিন্তু আমাদের পণ্য তো কম৷ তাই কোন দেশ কতটা লাভবান হবে তা এখনই বলা যায় না৷”
তার কথা, ‘‘তিস্তার পানি দিচ্ছে না৷ কিন্তু আরো ছয়-সাতটি নদীর পানি নিয়েও তো কোনো আগ্রহ দেখি না৷ আসলে আমাদের আগ্রহ থাকলেও তাদের আগ্রহ খুবই কম৷” তার মতে, আমরা যতই ভারতের সাথে সুসম্পর্কের কথা বলি না কেন দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু সুষম সম্পর্ক চায়৷ সেটাই আসলে দরকার৷
ইবাংলা/টিএইচকে/২৬আগস্ট,২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.