বার্ধক্য জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়; তাই তাকে স্বাভাবিকভাবে মোকাবিলা করা উচিৎ।এ সময়ে জীবনের নতুন মজা খুঁজে পেতে হয়। তবে, অনেক মানুষ যখন বৃদ্ধ হন, তখন মাঝে মাঝে হারিয়ে যান এবং একাবোধ করেন। তাহলে প্রবীণরা কীভাবে তাদের মন ভাল রেখে জীবনকে উপভোগ করেন? চীনে প্রবীণদের সুখী জীবন নিশ্চিত করতে সরকার কী কী করেছে?
কিছু দিন আগে আমি বিশেষ একটি স্কুলের নতুন সেমিস্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলাম। সবাই জানেন যে চীনে প্রতি বছরের ১লা সেপ্টেম্বর শুরু হয় প্রাথমিক স্কুল ও মাধ্যমিক স্কুলের নতুন সেমিস্টার। তবে, যে স্কুলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিই, সেটি শুধু শিশুদের স্কুল নয়, এটি বরং প্রবীণদেরও স্কুল। এ স্কুলের কোন ক্লাসরুম নেই। অনলাইনে সবাই ক্লাস নেন। গত ৩১ আগস্ট বেইজিংয়ে চীনা প্রবীণদের জন্য বিনামূল্যে সংস্কৃতি এবং শিল্প শিক্ষার অনলাইন প্ল্যাটফর্ম-রেড ম্যাপল ক্লাসরুম–চালু হয়েছে। এর মাধ্যমে তরুণ এবং মধ্যবয়সী সাংস্কৃতিক কর্মী এবং শিল্পীরা বিনামূল্যে বয়স্কদের জন্য সঙ্গীত, নাচ, বাদ্যযন্ত্র, ক্যালিগ্রাফি এবং পেইন্টিংসহ ৩৫টি লাইভ কোর্স পরিচালনা করেন। হাজারো প্রবীণ এতে অংশ নিতে নিবন্ধন করেছেন।
আরও পড়ুন…..ব্রিক্স দেশসমূহের অষ্টম সংসদ ফোরামে ভাষণ দিলেন লি চান শু
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং অনেক আগে থেকেই প্রবীণদের কাজের উপর গুরুত্বারোপ করে অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন। তাঁর সেসব ভাষণের চেতনার আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয় রেড ম্যাপল ক্লাসরুম। জনসংখ্যার বার্ধক্য সমস্যা মোকাবিলা এবং বয়স্কদের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদা মেটাতে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে অবসরপ্রাপ্ত মানুষের বিনোদন ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নানা ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। ২০২১ সালের নভেম্বর প্রকাশিত হয় ‘নতুন যুগে বার্ধক্যের কাজকে শক্তিশালী করার বিষয়ে সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাষ্ট্রীয় পরিষদের মতামত’। এতে বলা হয়, কমিউনিটি প্রবীণদের জন্য সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজনের জায়গা সরবরাহে সমর্থন করবে। আর ক্রীড়া ও সংস্কৃতি ছাড়াও প্রবীণরা লেখাপড়া করতেও আগ্রহী। নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়াও তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক।
লেখাপড়া করে প্রবীণরা মূল্যবোধ অর্জন করতে পারেন এবং জীবনের নতুন মজার খোঁজ পেতে পারেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনে প্রবীণদের জন্য স্কুলের সংখ্যা ৭৬ হাজার এবং মোট ১ কোটি ৪০ লাখ প্রবীণ স্কুল বা অনলাইন স্কুলে নিবন্ধিত হয়েছেন। চীনে ৬০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ২৬ কোটি ৪০ লাখ। তার মানে মাত্র ৫ শতাংশ প্রবীণ এখন লেখাপড়ার অধিকার উপভোগ করছেন।
প্রবীণদের লেখাপড়ার চাহিদা পূরণে গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীনে প্রকাশিত হয় চতুর্দশ পাঁচশালা পরিকল্পনার আওতায় প্রবীণ শিল্প উন্নয়ন ও অবসর সেবা ব্যবস্থার পরিকল্পনা। তাতে বলা হয়, কমিউনিটি স্কুল ও অনলাইন স্কুলের উৎসাহ দেয়ার কথা।
রেড ম্যাপল ক্লাসরুম এমনই একটি প্রবীণ শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম। আমি এ প্ল্যাটফর্মের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। লি ওয়ে চিয়ে ‘কু ছিন’ নামে একটি চীনা ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখছেন। তিনি জানিয়েছেন, অবসর নেয়ার পর তিনি একসময় বিভ্রান্ত ছিলেন। প্রতিদিন হাতে প্রচুর সময় ছিল। তবে কোনো কাজ ছিল না। অনেক আগে থেকে তিনি চীনের ঐতিহ্যিক সংগীত পছন্দ করেন; তবে, তার হাতে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখার সময় ছিল না।
আরও পড়ুন…..তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান
এখন তার সুযোগ হয়েছে। তিনি এক বছরের মতো কু ছিন শিখেছেন এবং এখন কয়েকটি সুর বাজাতে পারেন। তার মেয়ে তার কাছে থাকেন না। তাই বাদ্যযন্ত্র শিখা তাকে অনেক দেয়। পাশাপাশি, অন্য প্রবীণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি বন্ধুত্ব করেন।
রেড ম্যাপল ক্লাসরুমের প্রতিষ্ঠাতা চায়না এজিং ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সাংস্কৃতিক পেনশন জনকল্যাণমূলক কার্যক্রমের অফিসের উপপরিচালক উ হং জানিয়েছেন, রেড ম্যাপল ক্লাসরুম কার্যক্রম শুরু হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। মহামারি দেখা দেয়ার পর থেকে মানুষের ঘরে থেকে লেখাপড়ার চাহিদা বাড়ছে। অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের প্রবীণরা এতে ক্লাস নিতে পারেন। এসব ক্লাস তাদের জন্য বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। তারা মোবাইল ফোন ও কম্পিউটারের মাধ্যমে লাইভ অনুষ্ঠান দেখতে পারেন এবং শিক্ষকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন। ওয়েচ্যাটের মাধ্যমেও ক্লাস নিতে পারেন। ফলে তা আরও সহজ হয়েছে।
হো চুং পিংও একজন প্রবীণ শিক্ষার্থী। তিনি ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ক্লাস নেন। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, তার এ ক্লাস বেশ ভাল লাগে এবং ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা বিষয় লেখাপড়ার মাধ্যমে তার শারীরিক অবস্থা অনেক ভাল হয়েছে। আর অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তিনি প্রতিদিন ওয়েচ্যাটের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন, কথা বলেন এবং তারাও হোম ওয়ার্ক করেন ঠিক সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মতো। তা তার জীবনকে আরও আকর্ষণীয় এবং পরিপূর্ণ করে তুলেছে।
সবাই বুড়ো হয়ে যায়, আর বৃদ্ধ হলেও জীবনযাপন উপভোগ করতে হয়, ভালবাসতে হয়। খাবার এবং পোশাকসহ মৌলিক চাহিদা ছাড়া প্রবীণদের মানসিক চাহিদার উপর গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। তার বাস্তবায়নে সরকার এবং গোটা সমাজের অভিন্ন প্রচেষ্টা দরকার।
ইবাংলা /মআ/ ৮ ই সেপ্টেম্বর,২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.