একুশ শতকে রাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?
ইবাংলা ডেস্ক
রাজতন্ত্র মধ্যযুগের বহুল প্রচলিত শাসনব্যবস্থা হলেও কালের বিবর্তনে এখন মৃতপ্রায়। কিন্তু এখনো অল্পসংখ্যক রাষ্ট্রের পাশাপাশি কিছু উন্নত দেশও ঐতিহ্য হিসাবে নামসর্বস্ব রাজতন্ত্র টিকিয়ে রেখেছে। ভূপতির জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে রাজতন্ত্র নাম দেওয়া হলেও দেশ পরিচালিত হচ্ছে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। সম্প্রতি একুশ শতকে বিশ্বজুড়ে রাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা আছে কি না এই নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক। এজন্য অনেকের প্রশ্ন ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুই কি নামসর্বস্ব রাজতন্ত্রের সমাপ্তি ঘন্টা?
৭০ বছর রাজত্ব করে গত ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। রানির মৃত্যুতে প্রথামাফিক ব্রিটেনের রাজা এবং কমনওয়েলথ প্রধান হিসাবে তাঁর বড় ছেলে চার্লসের সিংহাসনে আরোহণের পর কমনওয়েলথভুক্ত বিভিন্ন দেশে রাজার কর্তৃত্ব শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে । সংস্থাটির বেশ কয়েকজন নেতার মতে, পদটি বংশগত হওয়া উচিত নয়। এখনো ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ব্রিটেনের রাজা। যদিও বেশিরভাগ দেশে ভূপতির শাসন নিয়ে আপত্তি উঠেছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতেই জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাজা রাজতন্ত্রের ভূমিকা ও তার প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরলেও আধুনিক যুগে রাজতন্ত্রের যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠছে।
আরোও পড়ুন…বশেমুরবিপ্রবি পিরোজপুরের প্রথম উপাচার্য জবি অধ্যাপক সাইফুদ্দিন
সমগ্র বিশ্বের প্রায় আড়াই বিলিয়ন মানুষ ও ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকা দেশগুলোর সংস্থা হচ্ছে কমনওয়েলথ। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি কমনওয়েলথের ৫৬টি দেশের মধ্যে নামমাত্র রাজতন্ত্র বিদ্যমান দেশগুলো হলো কানাডা,অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারবুডা, , বাহামা, পাপুয়া নিউগিনি, জ্যামাইকা, বেলিজ, গ্রেনাডা, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, টুভালু, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, সেন্ট লুসিয়া ও সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্রেনাডাইনস।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ উপনিবেশে থেকে বের হওয়ার পক্ষে বিভিন্ন দেশে নানা আলোচনা, সমালোচনা হচ্ছে। সিংহাসনে তৃতীয় চার্লসের যোগদানের পরই ক্যারিবিয়ান রাজনীতিতে রাজতন্ত্র বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে । ভিন্ন দেশি চার্লসকে রাষ্ট্রের অবিভাবক হিসেবে অপসারণের আহ্বানের পাশাপাশি কমনওয়েলথ ঘিরেও আছে নানা বিতর্ক। তাহলে কি রানির মৃত্যুর পরে রাজ পরিবারের ক্ষমতা সংকোচিত হতে যাচ্ছে? ইতোমধ্যে বার্বাডোস প্রজাতান্ত্রিক দেশে পরিণত হয়েছে।কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও জামাইকাতেও একই সুর শুনা যাচ্ছে।বেশিরভাগেরই দাবি সাংবিধানিক পন্থা অনুসরণ করে অবিলম্বে রাজতন্ত্রের ইতি টানা হোক।
পঞ্চাশের দশকে এলিজাবেথের সিংহাসনে বসার পরে অনেক দেশ প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলে রানি পরোক্ষভাবে কমনওয়েলথের মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে তার অধীনে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ২০১৮ সালে কমনওয়েলথের শীর্ষ সম্মেলনে রানির মৃত্যু হলে চার্লসকে রাজ্যের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকেই অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারমুডা, জ্যামাইকা, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইনসহ কয়েকটি দেশে রাজতন্ত্র থেকে বের হওয়ার আওয়াজ উঠে । তারই পরিপ্রেক্ষিতে রাজা তৃতীয় চার্লস কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকা প্রতিটি সদস্যের সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থা রাজতন্ত্র হবে, না প্রজাতন্ত্র হবে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার একমাত্র তাদের । এদিকে রাজপরিবারের শাসনে থাকা বাহামা, বেলিজ, গ্রেনাডা, সেন্ট লুসিয়া ও সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের জনগণের মতে রাজতন্ত্র ‘তার প্রাসঙ্গিকতা এবং তাৎপর্য হারিয়েছে’। তাদের মতে এখনি সময় এসব দেশে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার।
রানীর তিনটি সন্তানের বিবাহ বিবাহবিচ্ছেদের মধ্যে চার্লস এবং ডায়ানার প্রকাশ্য বিচ্ছেদ অনিবার্যভাবে রাজতন্ত্রের জৌলুস কলঙ্কিত করেছিল। সেই কলঙ্কের রেশ এখনো চলমান । প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী ডাচেস মেগান, কেবলমাত্র তাদের রাজকীয় দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নেননি, উপরন্তু তাদের ছেলে আর্চির সম্ভাব্য গায়ের রঙ নিয়ে রাজপরিবারে ‘উদ্বেগ এবং আলোচনারও সমালোচনা করেছিলেন। । তাই ইদানিং অনেকের প্রশ্ন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাসনাবসানের পর ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের কী হবে? বিশ্লেষকদের মতে, নজিরবিহীন বিরোধিতার শিকার হতে পারে রাজতন্ত্র । রানীর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার কারণে দীর্ঘদিন ধরে অনুচ্চারিত বিষয়গুলো তৃতীয় চার্লসের সময় উচ্চারিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
প্রকৃতপক্ষে চার্লসের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। বেশিরভাগ ব্রিটিশ এবং কমনওয়েলথভুক্ত নাগরিকের মতে রানি এলিজাবেথ ছিলো ঐক্যের জীবন্ত সত্ত্বা। রানির প্রচন্ড জনপ্রিয়তার কারণে স্কটিশ স্বাধীনতাকামীরাও রানীকে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের কাল্পনিক রাষ্ট্রপ্রধান চেয়েছিল। রাজা তৃতীয় চার্লসের জন্য পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ হলো তিনি কি সত্যিকার অর্থে তার মায়ের মত ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতীক হতে পারবেন?
রানীর মৃত্যু ব্রিটিশ রাজতন্ত্র এবং যুক্তরাজ্যের ভবিষ্যতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।কারণ, রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মধ্যে গ্রহনযোগ্যতায় আকাশ পাতাল ব্যবধান। একারণে, চারদিক থেকে রাজা চার্লসের উপর চাপ তৈরি হতে পারে। ইতোমধ্যে অসাধারণ মায়ের কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়া চার্লস জনসাধারণের অনুভূতির ভাষা বুঝে ঘোষণা দিয়েছেন জনগণের টাকায় রাজপরিবারের খরচ কমিয়ে আনার। সত্যিকার অর্থে রাজা তৃতীয় চার্লসও উপলব্ধি করেছেন একবিংশ শতাব্দীতে রাজতন্ত্রের স্বার্থকতা ও প্রাসঙ্গিকতা ক্রমবর্ধমান সন্দেহপ্রবণ জনসাধারণকে বোঝাতে ব্যর্থ হলে ব্রিটিশ রাজতন্ত্র টিকিয়ে রেখে রাজ্যগুলোকে ধরে রাখা তার জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে ।
আরোও পড়ুন…তিন পেরিয়ে উদ্যোক্তা ইরার “কাঠপোকা”
বাস্তবিক অর্থে, রানির প্রয়াণের পর ব্রিটিশ রাজশাসনের অস্তিত্ব নিয়ে যথেষ্ট সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। রাজতন্ত্র টিকে রাখার একমাত্র পথ মানুষের মনমানসিকতা ও নৈতিকতা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা এবং সাংবিধানিক নীতিকে সম্মান করে জনমনে আস্থাশীল নেতা হয়ে রানীর মত ধ্রুব নক্ষত্র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা । অন্যথায় তৃতীয় চার্লসের শেষ সময় পর্যন্ত কতগুলো রাষ্ট্র তার অধীনে থাকে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে রাজতন্ত্রবিরোধী স্রোত যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের স্থায়িত্ব হ্রাস পাবে, তা অবশ্যম্ভাবী। এখন রাজতন্ত্র বিরোধী স্রোতে নতুন রাজার রাজত্ব কতদিন স্থায়ী হয় সেটিই দেখার বিষয় ।
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট
ইবাংলা/আরএস/১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.