মাদারীপুর ও কালকিনিতে আড়িয়াল খাঁ নদীতে নতুন করে ভাঙ্গনের দেখা দিয়েছে। এ ভাঙ্গনের চাকায় পরে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শতাধিক বসতবাড়ি ও ফসলি জমি। এছাড়া বিগত দিনে নদীভাঙনে প্রায় কয়েকশত পরিবার ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
বর্তমানে ভাঙ্গন আরো বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে নদীর পাড়ের লোকজন। অপরদিকে ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে ওই এলাকার দুইশতাধিক পরিবার। আড়িয়াল খাঁ নদী ভাঙনকবলিত অনেক মানুষ কোনো প্রকার সহযোগিতা না পেয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার দ্রুত ভাঙনরোধের ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন…কালকিনিতে রাতের আঁধারে ইট বালু ফেলে ঔষধের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল নেওয়ার চেষ্টা
রোববার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শন করে যানা যায়, উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে রয়েছে চর কালকিনি ও চরহোগলপাতিয়া গ্রাম। এ গ্রামের ওপর দিয়েই বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ নদী। এ গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত হয়ে পড়ে রয়েছে। নেই কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও । বিগত দিনেও নদীতে চলে গেছে এ গ্রামের অনেক বাড়িঘর, কয়েকশ’ একর ফসলি জমি ও চরহোগলপাতিয়া হাওলাদার বাড়ির জামে মসজিদ। কিন্তু তখন কেউ এগিয়ে আসেনি এ গ্রামের মানুষের পাশে।
স্থানীয়রা জানান, আরিয়াল খাঁ নদী ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে গ্রামের অধিকাংশ বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন আর সরে যাওয়ারও জায়গা নেই। বৃষ্টির মৌসুম এলেই গরু-বাছুর, গাছপালাসহ মূল্যবান সম্পদ নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয়। দুই গ্রামের মানুষ ও তাদের জানমাল রক্ষার জন্য স্থায়ী বাঁধের দাবি জানিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
ভাঙন কবলিতদের অভিযোগ, বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নদীর ভাঙনরোধে কোনো কাজ শুরুই হয়নি এখনও। তবে মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে,স্থায়ীভাবে নদী ভাঙন রোধে সারা জেলায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা একনেকে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
সরেজমিন ভাঙন এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষার আগেই রুদ্ররূপ ধারণ করেছে আরিয়াল খাঁ নদ। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার চর কালকিনি এলাকা থেকে হোগলপাতিয়া পর্যন্ত সাড়ে ১৮ কিলোমিটার নদীতীরবর্তী এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন।
গত এক মাসে সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া গ্রামের এক শতাধিক বসতভিটা ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি এবং তিন একর জমির উপর কলার বাগান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসব এলাকার ভাঙন কবলিতরা সহায়-সম্বল হারিয়ে বাড়ি-ঘর ভেঙে কেহ রাস্তার পাশে বা অন্যের জমিতে আশ্রয় নিয়েছে। পরিবারের নারী-শিশুসহ গবাদি পশু নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ভাঙনে নিঃস্ব হওয়া মানুষেরা।
আরও পড়ুন…সোনাইমুড়ী-চাটখিলে পূজামন্ডপে অনুদান দিলেন আ.লীগ নেতা জাহাঙ্গীর
হোগলপাতিয়া গ্রামের জলিল বেপারী বলেন, আমাগো এই আরিয়াল খাঁ নদী ভাঙ্গনে প্রায় পাঁচ বিঘা জমি হারিয়েছি। আট বার ঘর সরিয়ে অন্য জায়গায় বসত গেড়েছি। আবার ভাঙ্গলে আর যাওয়ার কোন জায়গা থাকবে না।
স্থানীয় বাসিন্দা মকসেদ আকন বয়স ৯০ বছরের মতো। কৌতূহলে জানতে চাইলাম নদী ভাঙ্গন দেখছেন কতবার, তিনি বিস্ময়কর ভাবে বলেন,এখন তো কম নদী ভাঙ্গে। আমরা যখন জোয়ান ছিলাম তখন নিমিষেই ভেঙ্গে ঘরবাড়ি বিলীন হতে দেখেছি। আমি প্রায় ৮০ বারের বেশি দেখছি নদী ভাঙ্গন। চোখের সামনেই অনেকের বাড়ি ঘর নদী গর্ভে বিলীন হতে দেখেছি। ফসলি জমি বাড়ি ঘর হারিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন অনেকে। এখন যারা এই এলাকায় বসবাস করছেন তাদের অনেকেই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।এদের দেখার মতো কেহ নেই।
ভাঙনের মুখে থাকা স্থানীয় ইলিয়াস আকন বলেন, ‘আমরা খুব ঝুঁকির মুখে আছি। আমার আশে পাশে থাকা ১০ টি বাড়ি নদীতে নিয়ে গেছে।গত বছর আমার চাচাতো ভাই টিটল আকনের ঘর এক রাতের মধ্যে নদীতে নিতে গেছে। এখন আমি ভয়ের মধ্যে আছি,কখন যানি আমার ঘর নদীতে টান দেয়।এর আগে আমার একটি কলার বাগান ছিলো তাও নিয়ে গেছে। বউ পোলাপাইন লইয়া কই যামু,কি খামু আর কই থাকুম। আমাগো মরা ছাড়া আর গতি নাই। সরকার যদি একটা পাকা বান্ধের (বেড়িবাঁধ) ব্যবস্থা করত তাইলে অন্তত ভরসা পাইতাম।’
বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে লাল মিয়া হাওলাদার বলেন,বাড়ি তিনবার এই নদীতে নিয়ে গেছে এখন আমি রাস্তার পাশে একটি বাড়ি করে পোলাপান নিয়ে থাকি। সরকার যদি আমাদের একটু নদী ভাঙ্গন রোধ করে তাহলে আমরা ঠিকমত থাকতে পারবো।
ঝাউদি ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার লোকমান বেপারী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। তাদেরকে অবশ্যই সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।
আলীনগর ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান সাহিদ পারভেজ বলেন, আড়িয়াল খাঁ নদ ভাঙ্গন রোধের জন্য প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই সেখানেই জিওব্যাগ ফেলানো হবে। এবং ক্ষতিগ্রস্হ পরিবারকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে।
আরও পড়ুন…সাম্প্রদায়িক অপশক্তির কাছে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হার মানবেনা: এডভোকেট শাহিন
বিষয়ে জানতে চাইলে মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী এ বি এম মাহবুবুল আলম খন্দকার বলেন,যে এলাকায় ভাঙনে বেশি কবলিত সে এলাকার একটি তালিকা করা হয়েছে। শীঘ্রই সেখানে জিওব্যাগ দেওয়া হবে। আমরা স্থায়ীভাবে নদী ভাঙন রোধে সারা জেলায় দেড় হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্পটির সমীক্ষা চলছে। সমীক্ষার প্রতিবেদন হাতে আসলেই আমরা নদী বাঁধের কাজ সম্পন্ন করবো।
ইবাংলা/জেএন/০৫ অক্টোবর ২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.