ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

রাকিবুজ্জামান

আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান

– সুকান্ত ভট্টাচার্য

১৭ পেরিয়ে দুর্বার ১৮ তে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।অনেক বাধা,অনেক ঝড় অতিক্রম করে পুরান ঢাকার সদরঘাটে সমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে যাত্রা শুরু করা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে নবীন হলেও প্রতিষ্ঠান হিসাবে জগন্নাথ এর যাত্রা অনেক পুরনো।১৯৫৮ সালে ব্রাহ্ম স্কুল নামে যাত্রা শুরু করে আজকের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাস বলে,প্রয়াত জগন্নাথ রায় চৌধুরী ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।১৯৭২ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় জগন্নাথ স্কুল।খুব অল্প সময়ে পড়াশুনায় সুখ্যাতি অর্জন ও প্রসার ঘটায় তার পুত্র কিশোরী লাল রায় ১৮৮৪ সালে স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করেন।ব্রাহ্ম স্কুল থেকে নতুন নাম নিয়ে হয় ঢাকা জগন্নাথ কলেজ।

১৮৮৭ সালে শিক্ষা বিভাগ স্কুল ও কলেজ আলাদা করে দেয়।১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়।১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক, জার্নাল দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার সময় সহযোগিতা করে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়।

নারীদের সহ শিক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জগন্নাথ কলেজ।১৯৪২ সালে পুরান ঢাকার নারীদের শিক্ষার বাধা দূর করতে সহ শিক্ষা চালু করে।দেশভাগের কারনে ১৯৪৮ সালে সহ শিক্ষা বন্ধ হয়ে যায়।সহ শিক্ষা বন্ধ হলেও ১৯৪৯ সালে আবার স্নাতক পাঠক্রম শুরু হয়।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত প্রথম পুস্তিকা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ এবং সাব-টাইটেল ছিল ‘কী ও কেন?’ যার লেখক ছিলেন জগন্নাথ কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এ আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন জগন্নাথের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে প্রথম যে দশজন ১৪৪ ধারা ভেঙে ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র, প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ষাটের দশকেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করে সাহসিকতার পরিচয় দেন তিনি ।

১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের বীজ মূলত জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস থেকেই বপন করা হয়। ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনের নেতা হায়দার আকবর খান বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রথমে ছাত্র সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে কলেজ থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। পরবর্তী কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা এই আন্দোলনটি আঁকড়ে ধরেন।’

১৯৬৩ সালে তখনকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় কো-এডুকেশন চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারীকরণ করা হয়, কিন্তু পরের বছরেই আবার এটি বেসরকারী মর্যাদা লাভ করে।বাংলদেশের ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলনের ইতিহাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ওতোপ্রোত ভাবে জড়িত।১৯৭১ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয় সরকার।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জবি ক্যাম্পাসে গণহত্যা চালানো হয় । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শহীদ হন । ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। জগন্নাথ কলেজে হানাদারদের ক্যাম্প করা হয়। যুদ্ধ শেষে এখানে গণকবরের সন্ধান মেলে উদ্ধার করা হয় কয়েক ট্রাক ভর্তি মানুষের কঙ্কাল।

সরকারি জগন্নাথ কলেজ ২০০৫ সালে ৪টি অনুষদের অধীনে (কলা, বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ) ২০টি বিভাগ নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নামে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তীতে ২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত ফিন্যান্স এবং মার্কেটিং বিভাগ, ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত নৃবিজ্ঞান ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ এবং কলা অনুষদভুক্ত আইন বিভাগ চালু হয়।

২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, মাইক্রোবায়োলজি এন্ড বায়োটেকনোলজি ও ফার্মেসি বিভাগ চালু করা হয়। ২০১১ সালের ২২ জুন একাডেমিক কাউন্সিলের ১৫-তম সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে সেই বছরের ২৭ তারিখের ৩৯-তম সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদনক্রমে কলা অনুষদভুক্ত আইন বিভাগ নিয়ে আইন অনুষদ; বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত রসায়ন, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, পরিসংখ্যান ও কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ নিয়ে বিজ্ঞান অনুষদ এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিবেশ, মনোবিজ্ঞান, প্রাণিবিদ্যা, মাইক্রোবায়োলজি এন্ড বায়োটেকনোলজি ও ফার্মেসি বিভাগ নিয়ে লাইফ এন্ড আর্থ সায়েন্স অনুষদের কার্যক্রম শুরু হয়।

২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে কলা অনুষদের অধীনে ড্রামা এন্ড মিউজিক বিভাগ, ফাইন আর্টস এন্ড গ্রাফিক্স বিভাগ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে লোক প্রশাসন বিভাগ এবং ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন বিভাগ চালু করা হয়। এছাড়াও ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ হতে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে। ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে আইন অনুষদের অধীনে ভূমি আইন ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, লাইফ এন্ড আর্থ সায়েন্স অনুষদের অধীনে বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ চালু করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল ‘ফাইন আর্টস এন্ড গ্রাফিক্স বিভাগ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘চারুকলা’ বিভাগ এবং ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে ‘ড্রামা এন্ড মিউজিক বিভাগ’-কে পৃথক করে ‘সংগীত বিভাগ’ ও ‘নাট্যকলা বিভাগ’ নামে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ চালু করা হয়। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে সেন্টার ফর ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ বিলুপ্ত করে ইনস্টিটিউট অব মডার্ন ল্যাংগুয়েজেস চালু করা হয়।বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের আওতায় ৩৬টি বিভাগ ও ২টি ইনস্টিটিউট আছে। শিক্ষার্থী ১৩ হাজারের বেশি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ভাষা শহীদ রফিকউদ্দিন আহমদ,মৈয়মনসিংহ গীতিকার লেখক দীনেশচন্দ্র সেন, প্রখ্যাত আয়ুর্বেদ শাস্ত্র বিশারদ এবং শিক্ষাবিদ যোগেশচন্দ্র ঘোষ,শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, ব্রিটিশবিরোধী নৌ বিদ্রোহের শহীদ মানকুমার বসু ঠাকুর,ভাষা আন্দোলনের নেতা শওকত আলী (রাজনীতিবিদ),ভারতীয় অভিনয়শিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়,সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান,লেখক ও সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, যাদুকর জুয়েল আইচ,অভিনেতা প্রবীর মিত্র, অভিনেতা মীর সাব্বির,মুক্তিযোদ্ধা ও সঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবী, কবি-কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক শহীদ সাবের, বীর বিক্রম আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল, বীর প্রতীক এম হামিদুল্লাহ খান,বীর বিক্রম মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া,সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, শেখ ফজলুল হক মনি বিপ্লবী সুনীল দাস,সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, মুজিব বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান কাজী আরেফ আহমেদ।

 

বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে সাফল্য ব্যর্থতার ১৭ বছর

বাধা, শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।বিশ্ববিদ্যালয়টি আন্তর্জাতিক মানের হিসাবে নিজেদের জানান দিতে অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই সেমিস্টার পদ্ধতিতে পাঠদান করে আসছে। ইউজিসির প্রতিবেদনে এ-গ্রেডভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিসিএস,বিজিএস,পুলিশের উপ-পরিদর্শক নিয়োগসহ সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় নিজেদের সাফল্যের কথা জানান দিচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।এছাড়াও স্পেনের সিমাগো ইনস্টিটিউশন র‌্যাংকিং-২০২২ – এর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রসায়ন বিষয়ে গবেষণা সূচকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

সাফল্যের পাশাপাশি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা মোকাবিলা করে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হয়।বাংলাদেশের একমাত্র অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিত থাকলেও এই বছর মেয়েদের জন্য একটি আবাসিক হল চালু করে কিন্তু যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।১৩ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীদের জন্য মাত্র একটি মাত্র ক্যাফেটেরিয়া,পর্যাপ্ত ক্লাশরুম,খেলার মাঠের অভাব সহ নানা প্রতিকূলতা রয়েছে।

এতো কিছুর পর প্রতিবছর অনেক আশা নিয়ে দেশের একঝাঁক মেধাবী সন্তান এখানে শিক্ষার জন্য আসে।সবার আশা নতুন ক্যাম্পাস নিয়ে।যারা এখন ছাত্র হিসাবে আছে তারা জানে তারা হয়ত নতুন ক্যাম্পাসে কখনো ক্লাশ শুরু করতে পারবে না,কিন্তু তারা চায় তাদের পরে যারা আসবে তারা যেন তাদের জন্য উপযুক্ত পড়ার পরিবেশ পায়,তাদের জন্য থাকার জায়গা পায় এবং তারা যেন তাদের স্বপ্নের সাথে ডানা মেলতে পারে।

 

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.

Contact Us