বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে ছিনতাইয়ের পর সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাচ্ছে জলদস্যুরা। খুবই ধীরগতিতে উপকূলের দিকে এগোচ্ছে জাহাজটি। ২৪ ঘণ্টা পার হলেও গতকাল বিকাল পর্যন্ত জলদস্যুদের পক্ষ থেকে মুক্তিপণ বা অন্য কোনো দাবি জানিয়ে যোগাযোগ করা হয়নি। জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের সহযোগী সংস্থা এসআর শিপিং জাহাজের ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি উদ্ধারে অব্যাহতভাবে জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ খবর পর্যন্ত নাবিকরা সুস্থ আছেন।
গতকাল বিকালে জাহাজের মালিক এসআর শিপিংয়ের মূল কোম্পানি কবির গ্রুপের মিডিয়া ফোকাল পারসন মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। এখনো কোনো যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘জলদস্যুরা জাহাজ ছিনতাইয়ের পর আগে নিরাপদ জায়গায় যায়। তারপর সেখান থেকে নিজেদের ডিমান্ড জানায়। এখন পর্যন্ত জলদস্যুরা তাদের কোনো ডিমান্ড আমাদের জানায়নি। আমাদের অগ্রাধিকার হলো নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় মুক্ত করা। তারপর জাহাজ অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা। আমাদের কর্মকর্তারা কয়েকজন নাবিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা আমাদের জানিয়েছেন, জলদস্যুরা জাহাজটি সোমালিয়ায় নিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের কোনো ক্ষতি করেনি।’ নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এমভি আবদুল্লাহ উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে সোমালিয়া উপকূলের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর নাগাদ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে হাইজ্যাক হয়। পাইরেসি হওয়ার পর ইউকেএমটিওর যে অ্যালার্ম সেটা এসেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ৩৭ মিনিটে জাহাজটি উত্তর-পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল। গতকাল ভোর ৪টা ২৮ মিনিটে আরও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয় সোমালিয়া উপকূলের দিকে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী থেকে সর্বশেষ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের যে অবস্থান জানা গেছে, তা উল্লেখ করে নৌপরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৩৩ মিনিটে জাহাজটি উপকূল থেকে ৫৭০ নটিক্যাল মাইল দূরে ছিল। গতকাল সকাল ৬টা ৩৮ মিনিটে ছিল উপকূল থেকে ৪৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে। অর্থাৎ জাহাজটি খুব ধীরে ধীরে সোমালিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। জলদস্যুদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। যেহেতু তারা যোগাযোগ করেনি, তাই মুক্তিপণ বা কোন উদ্দেশ্যে তারা এটা করেছে জানা যায়নি। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী এবং সিনিয়র সচিবের নির্দেশনা অনুসারে আমরা বাংলাদেশে যত অথরিটি আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। একদিকে যেমন ডিপ্লোম্যাটিক এফোর্ট চলমান রয়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর বেশ কিছু দেশের সঙ্গে বাইলেটারেল ট্রিটি রয়েছে। সেটা ব্যবহার করে সামগ্রিকভাবে যতগুলো পদ্ধতিতে জাহাজ ও এর নাবিকদের মুক্ত করা যায়, সে লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি।
এদিকে ওই জাহাজের একাধিক নাবিক মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছেন। তারা পরিবারকেও অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন। হাইজ্যাক হওয়া জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান তাঁর স্ত্রীর কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় বলেছেন, ‘আমাদের থেকে মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে যে, এখানে যদি টাকা না দেয়, আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলছে। এদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলছে। এ মেসেজটা সবাইকে পাস করে দিও। এখন মোবাইল নিয়ে নিচ্ছে।’ জাহাজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাইদুজ্জামান জাহাজের মালিকপক্ষের কাছে পাঠানো অডিওতে বলেন, ‘স্যার, আমাদের মোবাইল টোবাইল সব সিজ করে নিচ্ছে। এটাই শেষ সুযোগ। আমাদের জাহাজের যে ইন্টারনেট সার্ভিস আছে, ওটা যদি ওপেন রাখেন আর কি, ওখানে যে কোনো সিচুয়েশনে মেসেজ রাখার চেষ্টা করব। ওটা খুলে দিয়ে রাখতে বলেন, তাহলে আমরা সুযোগমতো যোগাযোগ করব।’ এদিকে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, যে কোনো মূল্যে নাবিকদের দেশে ফেরত আনা হবে। তবে এখন পর্যন্ত মুক্তিপণ বা জলদস্যুদের দাবি সম্পর্কে কিছু জানা জায়নি। গতকাল দুপুরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক যৌথ সভায় জিম্মি জাহাজের ২৩ নাবিকের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, জিম্মি জাহাজের নাবিকদের মুক্ত করতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নৌবাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। নাবিকদের সুস্থভাবে ফিরিয়ে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর, নাবিকরা এখনো নিরাপদ ও সুস্থ আছেন, তবে জাহাজ এখন জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে আছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রথম গুরুত্ব হলো যারা নাবিক আছেন এবং সঙ্গে অন্য কেউ থাকলে তাদের জীবন নিরাপদ রাখা। নাবিকদের রক্ষা করা, উদ্ধার করা। বাংলাদেশের শিপিংব্যবস্থা এখন বিশ্বের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। পরশু বিষয়টি অবহিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আন্তর্জাতিক যতগুলো উইং নৌপরিবহনের কাজ করে, সবার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। নৌবাহিনীর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ অনেক বেশি, আমরা তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন সুস্থভাবে তাদের ফিরিয়ে আনার সব ব্যবস্থা করার জন্য। আমরা সে অনুযায়ী কাজ করছি। গত মঙ্গলবার ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এর ২৩ নাবিককে জিম্মি করে জলদস্যুরা। কবির গ্রুপের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়ে। এর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ ‘জাহান মণি’। তখন ওই জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
ইবাংলা/এম এস
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.