কাঁচামাল সংকটসহ নানাবিদ সংকটে পড়ে প্রায় দুই মাস বন্ধ থাকার পর অবশেষে পুনঃরায় কাগজ উৎপাদন শুরু করেছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কাগজকল কর্ণফুলি পেপারস মিলস কেপিএম।
বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে এই উৎপাদন শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করে কেপিএম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আব্দুল হাকিম জানান, কাঁচামাল সংকটে গত ২০ জুলাই হতে প্রায় ২ মাস কেপিএম কাগজ উৎপাদন করতে পারে নাই। সকল সংকট কাটিয়ে বুধবার রাত হতে মিলটি উৎপাদনে ফিরেছে।
এদিকে কেপিএম শ্রমিক কর্মচারী পরিষদ (সিবিএ) এর সভাপতি আবদুল রাজ্জাক জানান, বুধবার রাত হতে কেপিএম আবারও কাগজ উৎপাদনে ফিরেছে। আমরা শ্রমিক কর্মচারি সকলের পক্ষ হতে মাননীয় শিল্প উপদেষ্টা, বিসিআইসি কর্তৃপক্ষ এবং কেপিএম কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করছি মিলটি আবারও পুরোদমে উৎপাদনে ফিরে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। এরআগে গত ১২ সেপ্টেম্বর দুপুরে কেপিএম সিবিএ এর উদ্যোগে মিল চালু রাখার দাবিতে মিলের ১নং গেইটে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
আরও পড়ুন…১০০ গ্যাস কূপ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে: জ্বালানি উপদেষ্টা
উল্লেখ্য, কর্ণফুলি পেপার মিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কাগজের কল। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন-এর অধীনে ৬৭.৫৭ মিলিয়ন রুপি ব্যয়ে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের চন্দ্রঘোনায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কর্ণফুলি পেপার মিলটি শিল্প আইনের অধীনে নিবন্ধিত প্রথম কাগজশিল্প যা ৩০ হাজার শ্রমিক নিয়ে এশিয়ার সর্ববৃহৎ কাগজ-কল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো।
তৎকালীন সময়ে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন এবং ইতালির সহযোগিতায় ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় মিলটি স্থাপিত হয়। বাৎসরিক ৩০,০০০ টন ধারণক্ষমতা নিয়ে ১৯৫৩ সালে মিলটিতে প্রথমবারের মতো উৎপাদন আরম্ভ হয়। পরবর্তী সময়ে এটি দাউদ গ্রুপ অব পাকিস্তান-এর নিকট ভূর্তকি মূল্যে বিক্রয় করে দেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালে দাউদ গ্রুপ অব পাকিস্তান মিলটির সুষম আধুনিকায়ন ও যৌক্তিক উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৬৯-৭০ সালে কাগজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩১,৩৭৮ টন।
পূর্ব পাকিস্তানে দাউদের কেপিএম কাগজের ৫০টি সরবরাহকারী ডিলার ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর কেপিএম একটি পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। এরপর বাংলাদেশ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা (বিআইডিসি) এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে এবং এর উৎপাদিত পণ্যের নতুন বাজার সৃষ্টির জন্য প্রয়াসী হয়। বিআইডিসি বাংলাদেশে বিশেষায়িত পণ্য বিক্রয়ের জন্য ৪০৭টি নতুন প্রার্ন্তিক বা অনভিজ্ঞ ডিলার নির্বাচন করে।
কেপিএম ১৯৭৩-৭৪ সালে ১৯,০৪৪ টন কাগজ উৎপাদন করে। কাগজ তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশন কেপিএম’কে চালু রাখার জন্য বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে নিয়মিত কাঠের কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে এগিয়ে আসে। খুব অল্পসময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র-সাময়িকীর দ্রুত বিস্তার দেশে কাগজের চাহিদা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৭৬ সালে সরকার কেপিএম-এর সমস্যা শনাক্তের জন্য একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং ১৯৭৯-৮০ সালে ২৪০ মিলিয়ন টাকার একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এ কাজের জন্য ভারত, সুইডেন, আমেরিকা এবং জাপান থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হয়। ১৯৮৪ সালে কাগজের মান উন্নতকরণ, ব্যবহূত ধারণক্ষমতার উন্নতিসাধন ও কেপিএম-এর উৎপাদন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে ১৯৭২-৭৩ এবং ১৯৭৯-৮০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রতিবছর গড়ে ১৬১.৭৪ মিলিয়ন টাকার ক্ষতি কমানোর জন্য এর দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৮৩-৮৪ সালে কেপিএম ২৮.৩৯ মেট্রিক টন কাগজ ৭৩১ মিলিয়ন টাকায় বিক্রয় করে।
আরও পড়ুন…সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের বিদেশে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের
১৯৯১ সালে কেপিএম নিজের রুগ্নতা কাটিয়ে উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহারের মাধ্যমে বৈদেশিক বাজারে কাগজ রপ্তানি করতে সক্ষম হয় এবং ওই বছরে ৪,১০২ জন শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তা নিয়োগগ করা হয়। ১৯৯০-৯১ সালে কেপিএম-এর সংস্থাপিত ধারণক্ষমতা ছিল ৩৩,০০০ টন, প্রাক্কলিত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৮,৪৩৮ টন ও প্রকৃত উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০,২১৬ টন। ২০০৯-১০ সালে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৪,২০১ টন।
কেপিএম-এ কাগজ তৈরির জন্য যে মন্ড ব্যবহার করা হয় তা বিশেষত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সংগৃহীত কাঠ ও বাঁশ থেকে প্রাপ্ত আঁশজাতীয় কাঁচামাল। তাছাড়া সিলেট পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মন্ডও এ মিলে ব্যবহার করা হয়।
সৌরশক্তিকে গ্যাসে রূপান্তরের উপযোগী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পানি শোধনাগার প্লান্ট, গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র, একটি পুনরুদ্ধার শাখা এবং কাগজ জাতীয় বিভিন্ন সামগ্রীর একটি কনভার্টিং প্লান্ট দ্বারা কারখানাটি সজ্জিত থাকলেও বর্তমানে অনেকগুলো সেক্টর বিকল হয়ে গেছে।
ইবাংলা/ আইএইচ
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.