রাঙামাটির ফিসারী সংযোগ সড়কটি এখন যেন জীবন রেখা ভাবালু কাব্যের মোহনীয় প্রতিমা

আলমগীর মানিক,রাঙামাটি

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার রাঙামাটি শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কয়েকটি স্পটের নাম বলতে বলা হলে সবার আগে উচ্চারিত হয় ফিসারী সংযোগ সড়কটির নাম। তবে এটা অতীতের কথা, সাম্প্রতিক সময়ে অনাদর অবেহলা এবং দীর্ঘকালের পরিচর্যার অভাবে সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটিতে আসা পর্যটকদের চোখে ফিসারী সংযোগ সড়কটি আর তেমন কারো মনযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।

Islami Bank

অথচ একটি সময় ছিল যখন দুই পাশে অথৈ পানির মধ্যিখান দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা এই পথটিতে প্রবেশ করার সাথে সাথেই ভ্রমণ পিপাসুদের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠতো।

তখন সড়কটির দুই পাশে সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছে ফুটে থাকতো আগুন রাঙা চোখ ধাঁধানো ফুল; সবুজের ফাঁকে ফাঁকে রাল রঙের ব্যঞ্জনা দর্শকদের মুগ্ধ করতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই ফুলগাছ সরিয়ে সেখানে রোপণ করা হয় করই গাছ। এদিকে দীর্ঘ সময়ের সংস্কার দুর্বলতায় রাস্তার দুইপাশ গলে গলে পানিতে মিশে গিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়ে সড়কটি। এ নিয়ে পর্যটকদের আফসোসের সাথে রাঙামাটিবাসীর মাঝে জন্ম নেয় ক্ষোভ হতাশা।

এনিয়ে মানব বন্ধন মিছিল তো হয়েছেই, প্রকাশিত হয়েছে এন্তার প্রতিবেদন। কিন্তু কর্মকর্তাদের টনক নড়েনি। অবশেষে একজন কর্মকর্তা সড়কটিকে ক্ষয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন।

২০১৭ সালে পাহাড় ধসের পর আরো অনেক স্থানে ধস রোধে ধারক দেওয়াল নির্মাণের প্রকল্পে ফিসারী বাঁধে কিছু কিছু স্থানে রিটার্নিং ওয়াল (ধারক দেওয়াল) নির্মাণ করা হয়। তবে সেই উদ্যোগে পুরো বাঁধটিকে রক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি।

তার মধ্যেই সেই কর্মকর্তা চলে যান এবার আসেন এমন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, যার মনটা হয়তো কাব্যে ভরা। তিনি এবার পুরো বাঁধটি নিয়েই এমন একটি পরিকল্পনা হাতে নেন, পুরো বাঁধের একপাশটা সম্পূর্ণভাবে প্রতিরক্ষা দেওয়ালে সুরক্ষিত হয়।

কিন্তু এই প্রকৌশলী এবার চমক সৃষ্টি করেন, ভরাট করা মাটিতে বাগার করার উদ্যোগ নিয়ে। এই নির্বাহী প্রকৌশলীর নাম সবুজ চাকমা। তার বাগান পরিকল্পনা রাঙামাটি সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষকে তো বটেই সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে সৃষ্টি করেছে রঙিন স্বপ্ন। তবে প্রচার বিমুখ এই কর্মকর্তা কিছুই বলতে চাননা মুখ ফুটে।

সবুজের মাঝে লাল-হলুদ আর গোলাপে আবীর ছড়িয়ে দেয়া সবুজ চাকমা বলেন, আগে কাজটা তো হোক, তারপর এ নিয়ে এক সময় বিস্তারিত বলা যাবে। তার অবগুণ্ঠনে থাকা সেই পরিকল্পনার রেখা বেয়েই এখন সড়ত নিজের সৌন্দর্য বিকাশ করতে শুরু করেছে। সড়ক তো নয়, এ যেন ছোটখাট একটি পার্ক।

রাঙামাটি শহরের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ন সড়ক হিসেবে পরিচিত ফিসারী বাঁধ সড়কটির সৌন্দর্য্য ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এ যেন নব যৌবনা তরুণী। বাঁধের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ যত এগুচ্ছে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের কাছে এটা হয়ে উঠছে আকর্ষণীয় বিনোদন স্পট।

সড়ক বিভাগ থেকে জানাগেছে, রাঙামাটি শহর রক্ষা ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় রাঙামাটি-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কের সংযোগ স্থাপনে ১৯৬৪ সালে নির্মিত হয় ফিশারি সড়কসংযোগ বাঁধ।

নির্মাণের পর দীর্ঘ সময় ধরে সংস্কার করা হয়নি বাঁধটি। ফলে দিনের পর দিন কাপ্তাই হ্রদের ভাঙনের কবলে পড়ে এবং মাটি ধসে যাওয়ায় বাঁধে মারাত্মক ক্ষতি হতে থাকে, হুমকির সম্মুখীন হয়। বর্ষায় ঝুঁকি বেড়ে যায়।

সবশেষ ২০১৭ সালের জুনে রাঙামাটিতে ভয়াবহ পাহাড় ধসে বাঁধটির অস্থিত্ব চরম বিপর্যস্থ হলে সংস্কারের পদক্ষেপ নেয় সরকারের সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ রাঙামাটি।

one pherma

সূত্র জানায়, ‘রাঙামাটি সড়ক বিভাগের অধীন পাহাড় ও ভূমি ধসে ক্ষতিগ্রস্থ সড়কের বিভিন্ন কিলোমিটারে ড্রেনসহ স্থায়ী প্রতিষ্ঠামূলক আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের (প্রথম সংশোধিত) আওতায় বাঁধটি রক্ষার জন্য সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ হাতে নেওয়া হয়।

২৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে, যা শেষ হবে চলতি জুনে। প্রকল্পে ৬৬৩ মিটার দৈর্ঘ্যের বাঁধের একপাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ও মাটি ভরাট করে সম্প্রসারণ কাজ করা হয়।

ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৭ শতাংশের কাজ শেষ হয়েছে, যাতে বরাদ্দের ২৫২ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। বর্তমানে বাঁধের সম্প্রসারিত পাশের অংশে সৌন্দর্য বর্ধনসহ কিছু মনোরম বিনোদন স্পট স্থাপনার কাজ চলছে।

এদিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলরাশি কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির পর রাঙামাটি শহরের তিনটি এলাকা রিজার্ভ বাজার, তবলছড়ি ও বনরূপাকে ফিশারি সড়ক সংযোগ বাঁধের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়েছিল। কাপ্তাই হ্রদের দুই পাশে মধ্যখানে অবস্থিত কয়েকটি দ্বীপকে একত্রিত করে এই সড়কের সংযোগ স্থাপন করা হয়।

দুই পাশের হ্রদের সৌন্দর্য্যরে কারণে এই স্থানটি স্থানীয় দর্শনার্থী ও পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয়; কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত এ বাঁধের উজানের পাশ ভাঙতে ভাঙতে রাস্তার তীরবর্তী স্থানে গিয়ে পৌঁছায়। এরআগে যে কোনো মুহূর্তে সড়কটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলে সড়ক বিভাগ বলি¬ (গাছের খুঁটি) দিয়ে আপৎকালীন সড়কটি সচল রাখে।

অন্যদিকে বিভিন্ন সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ, রাঙামাটি পৌরসভা ও পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধটি রক্ষা ও সৌন্দর্যবর্ধনে উদ্যোগ নিলেও এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার পক্ষে বাঁধটি রক্ষায় কেউ এগিয়ে আসেনি।

একাধিক তথ্যসূত্র মতে, ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙামাটিতে ভয়াবহ পাহাড়ধসে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেই সময় জেলাজুড়ে সড়কের ১৫১টি অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।

ক্ষতিগ্রস্ত সেসব সড়ক মেরামত, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও পাহাড় ধস রোধে ২৮৬ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে সড়ক বিভাগ। এ প্রকল্প থেকেই ৬৬৩ মিটার দৈর্ঘ্যরে ফিশারি সড়ক সংযোগ বাঁধের সংস্কার, উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।

সড়ক ও জনপথ বিভাগের রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ চাকমা বলেন, রাঙামাটি সড়ক বিভাগের অধীন পাহাড় ও ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্থ সড়কের বিভিন্ন কিলোমিটারে ড্রেনসহ স্থায়ী প্রতিষ্ঠামূলক আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাঁধটি রক্ষায় সংস্কার ও উন্নয়ন কাজের হাতে নেওয়া হয়।

২৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। শেষ হবে সামনের জুনে। প্রকল্পে ৬৬৩ মিটার দৈর্ঘ্যের ফিশারি সড়ক সংযোগ বাঁধের একপাশে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ও মাটি ভরাট করে সম্প্রসারণ কাজ করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রায় ৯৭ শতাংশের কাজ শেষ। বর্তমানে বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির এডিপি (এশীয় ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) খাতে বরাদ্দের ৮৮ লাখ টাকায় সৌন্দর্য বর্ধনসহ কিছু বিনোদন স্পট তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।

এখন সৌন্দর্য পিপাসু মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে পূর্ণতা পাবে সবুজ চাকমার পরিকল্পনা, আর মূর্ত হয়ে ধরা দেবে লীলাময়ী প্রকৃতির বুকে মানুষের ছোঁয়ায় গড়ে তোলা কাব্যের প্রতীমা।
ইবাংলা বাএ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.

Contact Us