সুইটি ইসলাম (ছদ্মনাম)। বয়স ১৭ বছর। বাড়ি শরীয়তপুর জেলার চন্দনকর এলাকায়। বছর খানেক আগে ফেসবুকে টিকটক গ্রুপের মাধ্যমে শিহাব নামে যশোরের এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। একপর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক হয় তাদের। কিন্তু শিহাব যে তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছেন, তা বুঝতে পারেনি সে।
এরই একপর্যায়ে গত সোমবার সুইটি শরীয়তপুর থেকে তিন হাজার টাকায় মোটরসাইকেল ভাড়া করে একাই চলে যায় যশোরে শিহাবের কাছে।
সুইটির ভাষ্যমতে, যশোরে পৌঁছানোর পর প্রথমে একটি হোটেলে ওঠানো হয় তাকে। সেখানে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। এরপর ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় একটি নির্জন গ্রামে। সেখানেও চলে ধর্ষণচেষ্টা। তবে যশোরে পরিচিত কেউ না থাকায় এসবের প্রতিবাদ করার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিল না মেয়েটি।
এরই মাঝে তাকে ভারতে পাচারের জন্য সেখান থেকে নেয়া হয় বেনাপোল বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে সুযোগ বুঝে মেয়েটি আশপাশের লোকজনকে জানিয়ে দেয় যে, সে পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছে। এ সময় কৌশলে পালিয়ে যান শিহাব।
এ ঘটনার পর সুইটিকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে যশোর জেলা প্রশাসন যোগাযোগ করে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসনের সঙ্গে। এ যাত্রায় বেঁচে যায় মেয়েটি। কিন্তু টিকটক গ্রুপের মাধ্যমে পাচারকারীদের হাতে পড়ে আরও কত মেয়ে যে ভারতের অন্ধকার জগতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তার কোনো হিসাব নেই।
যেভাবে পাচার হয়
একটা সময় পর্যন্ত সাধারণত আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের মেয়ে, গার্মেন্টসকর্মী এমনকি বিধবা নারীদের টার্গেট করে অনেক টাকার স্বপ্ন দেখিয়ে বিদেশে পাচার করা হতো। এ জন্য দালালের মাধ্যমে টার্গেট নারী বা তাদের পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হতো।
বছর দুয়েক আগে দেশে ‘টিকটক কালচার’ জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এই অনলাইন সামাজিকমাধ্যমের মোহে পড়তে শুরু করে উঠতি বয়সী মেয়েরা। আর এ সুযোগ নেয় নারী পাচারে সক্রিয় পুরোনো এই চক্র। কারণ, টিকটক গ্রুপের অ্যাডমিনদের মাধ্যমে অনলাইনে সহজেই হ্যাং আউট বা পুল পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
দুই বছর ধরে এভাবে তারা টিকটক গ্রুপের নারী সদস্যদের ছলেবলে বিদেশে শুটিং-অডিশনের কথা বলে পাচার করছে। বিশেষ করে ভারতে। প্রতিবেশী এই দেশটিতে নেয়ার সময় পথে পথে তাদের করা হয় ধর্ষণ। কিছু ক্ষেত্রে এসব ঘটনায় ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেয়া হয়। একপর্যায়ে বাধ্য করা হয় যৌন পেশায়।
ই বাংলার এক অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, পুরোনো এই চক্রটি আগের মতোই পুরোনো গার্মন্টসকর্মী দিয়ে নতুন গার্মেন্টসকর্মীকে প্রলোভনের মাধ্যমেও পাচার করছে। এ ছাড়া স্বর্ণ চোরাকারবারিদের একটি চক্র নারী পাচারে জড়িয়েছে। এই চক্রের কেউ কেউ স্থানীয় দালালের মাধ্যমে বিদেশে নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচার করছে।
বেশির ভাগই থেকে যায় ‘অন্ধকার জগতে’
পাচার হওয়ার পর যৌন নির্যাতনের শিকার এসব ভুক্তভোগীর কিছু অংশকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বেশির ভাগই থেকে যায় অন্ধকার জগতে।
পাচার হওয়া মানুষ নিয়ে কাজ করে ‘রাইটস যশোর’ নামের একটি বেসরকারি সংগঠন। তাদের তথ্য বলছে, শুধু যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই ২০১৯ সালে ফেরত আনা হয়েছে পাচার হওয়া ৩৫ নারীকে, যাদের মধ্যে ছিল ৯টি মেয়েশিশুও।
২০২০ সালে একই সীমান্ত দিয়ে ফেরত আনা হয়ে ২৫ নারী ও ১৯ মেয়েশিশুকে। আর চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে বেনাপোল দিয়ে ফেরত আনা হয়েছে চার মেয়েশিশু ও ১৩ নারীকে।
রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, গত ১৭-১৮ মাসে টিকটকের ফাঁদে ফেলে পাচার করা হয়েছে বহু মেয়েকে। কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে উদ্ধার করা গেলেও বেশির ভাগই এখনো ভারতে রয়ে গেছে। করোনার বিধিনিষেধের কারণে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
যেভাবে ফিরিয়ে আনা হয় পাচার হওয়া নারীদের
এ প্রসঙ্গে রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক নিউজবাংলাকে বলেন, ভারতে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন কারণে রেড দেয় পুলিশ। তখন পাচার হওয়া যেসব মেয়েকে জোরপূর্বক যৌন পেশায় লিপ্ত করা হয়, তাদের অনেকে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। তারপর তাদের বেসরকারি সেফ হোমে রাখা হয়।
তিনি বলেন, ‘সেফ হোম থেকে আমরা তথ্য পাই। তারপর একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনকে। তারা বিষয়টা ভারতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানায়।
‘এরপর ভুক্তভোগীদের ট্রাভেল পাস মেলে। ওই ট্রাভেল পাস নিয়েই দেশে ফিরতে পারেন তারা। এভাবে বেনাপোল বন্দর দিয়ে পাচারের শিকার নারীরা যখন দেশে আসেন, তখন আমরা তাদের সংখ্যা হিসাব করি।’‘স্বপ্ন দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে ইজ্জতের ওপর হাত দেয় ওরা’
সম্প্রতি বাংলাদেশে ফিরে আসা এক নারী নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন তার নির্মম অভিজ্ঞতার কথা।
তিনি বলেন, ‘একেকজন একেক কারণে পাচার হয়। অনেকজনকে একসঙ্গে নিয়ে যায় না পাচারকারীরা। কাউকে ভালো ইনকামের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়। কাউকে নেয় মডেল বানানোর প্রলোভন দিয়ে। কাউকে কাউকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিয়ে যাওয়া হয়।’
ওই নারী বলেন, ‘ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে এসব জানতাম না। কারণ আমাদের তিনজনকে ভালো কাজের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ওখানে গিয়ে দেখি সবই গল্প। একেকজনকে একেক কথা বলে পাচার করা হয়েছে।
‘স্বপ্ন দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে ইজ্জতের ওপর হাত দেয় ওরা। একটা মেয়ে যখন পাচার হয়, তখন ঘাটে ঘাটে ধর্ষণের শিকার হয়। ওটা যে কী আজাব, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’ ওই সব বাচ্চার যে কী হয় আল্লাই ভালো জানে’। পাচারের পর নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা আরও এক নারীর সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা।
তিনি বলেন, ‘এক অমানুষ নিয়ে যায় আরেক অমানুষের কাছে। এভাবে কত অমানুষের হাতে যে আমাদের পড়তে হয়, তা বলে বোঝাতে পারব না। তারপর বিক্রি করে দেয় ভারতীয় দালালদের কাছে।
‘তারা আবার বিক্রি করে দেয় হোটেলে, গোপন বাসাবাড়িতে বা পতিতালয়ে। এসব জায়গায় থাকতে থাকতে অনেক মেয়ের পেটে বাচ্চা চলে আসে। মেয়েটি দেখতে সুন্দর হলে বাচ্চার ভ্রূণ নষ্ট করে দেয়া হয়।’‘গোপন বাসাবাড়িতে’ যেসব মেয়েকে রাখা হয়, তাদের মধ্যে কারও কারও পেটে বাচ্চা এলে নষ্ট করা হয় না বলে জানান তিনি।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে মেয়েটি বলেন, ‘যারা গোপন বাসায় পড়ে, অনেক সময় তারা বাচ্চা নষ্ট না করলেও কিছু বলা হয় না, বিশেষ করে যারা দেখতে তেমন আকর্ষণীয় না, বয়স ত্রিশের ওপরে তাদের।
‘একপর্যায়ে সেই সন্তানের জন্ম ওই সব গোপন বাসায়ই হয়। যখন পুলিশ রেড দেয়, তখন বাচ্চাগুলোকে ওখানে রেখেই বাংলাদেশে চলে আসে। ওই সব বাচ্চার যে কী হয় আল্লাই ভালো জানে। শুনছি, ওসব বাচ্চা নাকি ওই দেশে যাদের বাচ্চা হয় না, তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়।’