বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যু কোনোভাবেই গণতন্ত্রের সাথে যায় না। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেশ-বিদেশে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। সর্বশেষ শুক্রবার (২৬ নভেম্বর) টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। র্যাবের দাবি, তারা ‘রোহিঙ্গা ডাকাত’।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৫৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। গত বছরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২২২ জন। তবে এ ধরনের মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সর্বাধিক ২০১৮ সালে, ৪৬৬ জন।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৪২ জনের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, কোনো অভিযানের সময় সন্ত্রাসীরা গুলি চালালেই তারা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হন। অনেক সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আহত ও নিহত হন।
তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিচারব্যবস্থা যদি থাকে, সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোক্রমেই গণতন্ত্র বা সভ্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যায় না।
মানবাধিকারকর্মী খুশি কবীর বলেছেন, ‘আমাদের বিচারের একটি পুরো সিস্টেম আছে। যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য বিচারব্যবস্থা একটি স্তম্ভ। বিচারব্যবস্থা যদি থাকে, সেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনোক্রমেই কোনো গণতন্ত্র বা সভ্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যায় না। তাহলে বলতে হবে আমরা টোটালি কোর্ট (আদালত) বাতিল করে দেব, যার যা ইচ্ছা যাদের হত্যা করবে। এখানে কোনো কোর্ট লাগবে না, আইনজীবী লাগবে না, ল ডিগ্রি পাস করা লাগবে না। এখানে কোনো বিচারব্যবস্থা থাকার দরকার নেই।’
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার মৃত্যুর পর এ প্রবণতা কিছুটা কমে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি একজন পরিচিত লোক ছিলেন এবং তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় ছিলেন, সে কারণে হয়তো একটু হইচই হয়েছে। অনেক লোকেরা মুভ করেছে। এটা কিছু সময়ের জন্য থামে আবার শুরু হয়ে যায়।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এলাকায় চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান। এরপর দেশজুড়ে তোলপাড় ও সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনার পর এ বিষয়ে বেশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অপরাধীরাও আতঙ্কে রয়েছে।
আসকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত নয় বছরে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির হাতে ২ হাজার ৪২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে ১ হাজার ৫৯২ জন। ২০১৩ সালে ২০৮, ২০১৪ সালে ১৫৪, ২০১৫ সালে ১৯২, ২০১৬ সালে ১৯৫, ২০১৭ সালে ১৬২, ২০১৮ সালে ৪৬৬, ২০১৯ সালে ৩৮৮, ২০২০ সালে ২২২ ও ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৫৫ জন।
চলতি বছর ৫৫ জনের মধ্যে ১১ জনই রোহিঙ্গা। আর ২০২০ সালের আলোচিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মধ্যে ৪৫ জনই ছিল রোহিঙ্গা। এ ছাড়া ১৮ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা পুলিশ হেফাজতে এক নারীর মৃত্যু, ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে আটকের পর কল্পনা বেগমের মৃত্যু হয়।
ইবাংলা / নাঈম/ ২৭ নভেম্বর, ২০২১