নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পরিবর্তে জেলার দায়িত্ব আমলাদের দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় সংসদে। সোমবার (২৮ জুন) সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের একাধিক জ্যেষ্ঠ সদস্য এনিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ তার বক্তব্যে বিষয়টি উত্থাপন করে বলেছেন, জেলার দায়িত্ব সচিবদের দেওয়ায় রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
পরে তার বক্তব্যকে সমর্থন করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, দেশে আজ কোনো রাজনীতি নেই। দেশ চালাচ্ছেন আমলা ও জগেশঠরা। রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ দেশ স্বাধীন করেছেন রাজনীতিবিদরা।
বাজেট আলোচনায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ আরও বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা যারা এই জাতীয় সংসদের সদস্য, এমন একজনও নাই যিনি এই করোনাকালীন সময়ে নিজস্ব অর্থায়নে বা যেভাবেই হোক গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি। সবাই দাঁড়িয়েছেন।
আমি আমার নিজের এলাকায় ৪০ হাজার মানুষকে রিলিফ দিয়েছি। এখন, মাফ করবেন, কথা বলাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত জানি না, এখন আমাদের জেলায় জেলায় দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা। মানুষ মনে করে আমরা যা দেই, এটা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দেন।
প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মাঠে যাননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাকে দেওয়া হয়েছে তিনি এখন পর্যন্ত যাননি। এটা কিন্তু ঠিক না। একটা রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব বা কাজ, সেটা কিন্তু ম্লান হয়ে যায়।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ফেরাউনের সময়ও আমলা ছিল। এসব কথাবার্তা মানুষ পছন্দ করে না। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী এমপিরা সচিবদের ওপরে। এ জিনিসটা খেয়াল করতে হবে। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও থাকবে, কিন্তু যারা রাজনীতিক, যারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তাদের যে স্থান নির্ধারিত সেটা থাকা উচিত।
তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়া বলেছিলেন, তিনি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে দেবেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে কাজটা করেছেন। তিনি সত্যিই রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতিটা বড় কঠিন করে গেছেন। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
আওয়ামী লীগের এই বর্ষীয়ান নেকা আরও বলেন, আমাদের জেলায় একজন সচিব যাবেন, আমরা তাকে বরণ করে নেব, ঠিক আছে। কিন্তু তারা যান না। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন। তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। সেখানে গেলে কর্মীরা আসত। মন্ত্রীরা গ্রামে-গঞ্জে যেতেন। কোথায় যেন সে দিনগুলো হারিয়ে গেছে।
হেফাজতে ইসলাম জঙ্গি সংগঠন, এদের নিষিদ্ধ করা হোক : শেখ সেলিম
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত দেশের বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সরকার পতন।
স্বাধীনতা দিবস ওরা সহ্য করতে পারে না, ওদের বুকে ব্যথা লাগে। কথা নাই, বার্তা নাই বায়তুল মোকাররমে জমা হয়ে তাণ্ডব চালায়। সেখানে মুসল্লিরা নামাজ পড়তে পারেন না। বায়তুল মোকাররমে এ ধরনের সমাবেশ নিষিদ্ধ করা উচিত। তারা বায়তুল মোকাররমকে প্ল্যাটফরম বানিয়েছে। এই হেফাজতে ইসলাম ছিল স্বাধীনতাবিরোধী নেজামে ইসলামি।
শেখ সেলিম বলেন, মানুষ মেরে এরা ইসলামকে হেফাজত করবে কীভাবে? এটা জঙ্গি সংগঠন, এ সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হোক। যেভাবে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হয়েছে, সেভাবে এদের বিরুদ্ধেও জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতাকে প্রধান শত্রু উল্লেখ করে শেখ সেলিম আরও বলেন, পাকিস্তান আমলে অধিকার আদায়ের কথা বললেই ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে শাসন করা হয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করা, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন।
স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি আন্তর্জাতিক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। জিয়াউর রহমান এসে এদের রাজনীতি করার অনুমতি দেয়, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার সুযোগ করে দেয়। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করে। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বি’ মানে ‘বাংলাদেশ’, ‘এন’ মানে ‘না’ এবং ‘পি’ মানে ‘পাকিস্তান’; অর্থাথ ‘বাংলাদেশ না পাকিস্তান’।
জিয়া জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের স্থান করে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি ও মুক্তিযোদ্ধাদের শেষ করা। তিনি আরো বলেন, বিএনপির আদর্শ হত্যা ও অপরাধ করা। এরা মানবতার, গণতন্ত্রের ও জনগণের শত্রু।
এরা জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের পক্ষের লোক। ’৭৫ থেকে এদেশে যত হত্যা-অপরাধ সবকিছুর সঙ্গে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া জড়িত। বিএনপির উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা যে অপরাধ করেছেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। জানি না, আল্লাহ ক্ষমা করবেন কি না, তবে জনগণ আপনাদের ক্ষমা করবেন না।
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, আজকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলা হয়। দুর্নীতি, দুঃশাসন ও ভয়ের সংস্কৃতির মাধ্যমে জেনারেল সাহেবরা দেশ চালিয়েছেন। তাদের আমলে সীমিত, ঘরোয়া এবং কাকাতুয়া-ময়নার রাজনীতি দেখেছি।
কারফিউ জারি করে তারা রাজনীতি করেছেন। জিয়া যেদিন নিহত হন সেদিনও ঢাকায় কারফিউ ছিল। যারা কারফিউ দিয়ে দেশ শাসন করে তাদের মুখে রাজনীতির কথা মানায় না। আজকে বলতে পারি, সব বাধা-বিপত্তি উের এবং অসীম সাহস নিয়ে দেশকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০০৮ সাল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। তখন দেখেছি, ‘দেশে বিদ্যুত্ নাই, খাবার নাই।’ অথচ কথায়-কথায় রাজনৈতিক সরকারকে গালাগাল করা হয়। আমলাদের-সামলাদের হাতেও দেশ দেখেছি।
জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো টাকার কারণেই করোনার এই মহামারির মধ্যেও আমাদের রেমিট্যান্সে ধস নামেনি। তারা দেশে টাকা পাঠাচ্ছে। আর আমরা বিদেশে টাকা পাচার করছি।
ব্যারিস্টার আনিসুল বলেন, দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে কত হাজার হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। আর এই শ্রমিকরা ঘরবাড়ি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। আমাদের মোট শ্রমিকের ৩৫-৪০ ভাগ বিদেশে কর্মরত। একবারও কী ভেবেছি, করোনার মধ্যে এই শ্রমিকরা দেশে ফিরলে পরিস্থিতি কী হতো! অথচ বাজেটে তাদের জন্য তেমন কিছু রাখা হয়নি।
জাপার জ্যেষ্ঠ এই এমপি বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। বরাদ্দ আরো বাড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্ষমতা এবং জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের করোনার টিকার কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। আমাদের অনেক অর্জন আছে। কিন্তু আমরা যদি সবাইকে টিকার আওতায় আনতে না পারি তাহলে সব অর্জন শূন্য হয়ে যাবে।
জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে জেলার দায়িত্ব আমলাদের দেওয়ার ঘটনায় আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যকে সমর্থন করেন। ফিরোজ রশীদ বলেন, আজকে দেশে কোনো রাজনীতি নেই। তোফায়েল আহমেদ যথার্থ বলেছেন।
দেশ আজ রাজনীতিশূন্য, কোথাও রাজনীতি নেই। প্রত্যেকটা জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন। আর এমপি সাহেবরা পাশে বসে থাকেন, দূরে। তারপর বলেন—ডিসি সাব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের সঙ্গে যখন কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না। এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, কারণ দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতির নামে এখন পালাগানের অনুষ্ঠান হয়। সন্ধ্যার সময় ওবায়দুল কাদের একদিকে পালাগান করেন, একটু পর টিভিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরেকটা পালাগান করেন। আমরা রাজনীতিবিদরা ঘরে বসে টেলিভিশনে পালাগানের রাজনীতি দেখি। এই পালাগান চলছে ১০ বছর।
তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট আগাগোড়াই ধনী ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে। ’৭২-এ সংসদে রাজনীতিবিদ ছিলেন ৯৫ শতাংশ, আর ব্যবসায়ী ছিলেন ৫ শতাংশ। বর্তমানে সংসদে রাজনীতিবিদ ২৫ আর ব্যবসায়ী ৭৫ শতাংশ।
রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে-আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছে। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগেশঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এই হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য।
পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর বা মেট্রো রেল করা হলেও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া জনগণ এটার সুফল পাবে না মন্তব্য করে ফিরোজ রশীদ বলেন, রাজনীতিবিদ ছাড়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট থাকে না। বাতাস যেদিকে তারা সেদিকে ছাতা ধরে। ক্ষমতায় আমরাও ছিলাম, তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।
ইই/ জাতীয় সংসদ/ ২৯ জুন, ২০২১