আমলা নির্ভরতা : সত্যিই কী রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব ম্লান হচ্ছে?

ওয়েব ডেস্ক :

বিগত জাতীয় নির্বাচনের পর বেতনে যতনে দায়িত্বে বা কতৃর্ত্বে মাঠ যে আমলাদের দখলে গেছে তা বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। সরকারের নীতি কিংবা জনকল্যানমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে এখন আর জনপ্রতিনিধিদের জায়গা নেই। সবখানে আমলারা।

যে মহামারি চলছে তা মোকাবিলয় জনপ্রতিধিদের অংশগ্রহণ খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু এই কাজে সংসদ সদস্য কিংবা অন্য স্তরের জনপ্রতিনিধিদের রাখা হচ্ছে না। জনসচেতনা সৃষ্টি, ত্রাণবিতরণ কিংবা স্বাস্থ্য সেবা- সবকিছুই করছেন আমলারা। জেলায় ত্রাণ বিতরণর সমন্বয় করছেন সচিব।

আর সরাসরি দায়িত্বে আছেন জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। প্রধানমন্ত্রী ঢাকা থেকে জেলায় জেলায় যে ভার্চুয়াল সভা করেন সেখানে জেলা প্রশাসকরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সংসদ সদস্যরা পাশে বসে থাকেন মাত্র। অথচ সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় এমনটা হওয়ার কথা না।

এসব কারণে বিভিন্ন মহল থেকে বেশ কিছুদিন ধরে বলা হচ্ছিল সরকার পুরোপুরি আমলা নির্ভর হয়ে পড়েছে। এই অভিযোগ এখন খোদ সরকারি দলের এমপিদের মুখ থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে; তা আবার পার্লামেন্টে। অন্য দলের সদস্যরাও আমলা নির্ভরতার সমালোচনায় মুখোর।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি দলের সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘যেসব সংসদ সদস্য এখানে উপস্থিত, এমন একজনও নেই যিনি নিজস্ব অর্থায়নে বা যেকোনোভাবে গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াননি।

সবাই দাঁড়িয়েছেন,আমরাও দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এখন আমলাদের জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মানুষ মনে করে, আমরা যা দেই এগুলো দেন প্রশাসনিক কর্মকর্তারা। অথচ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কিন্তু দেননি। অনেকেই এলাকায় যাননি। আমার নিজের জেলা ভোলায় যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তিনি এখন পর্যন্ত যাননি।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা কিন্তু ঠিক না! এটা একটা রাজনৈতিক সরকার। রাজনীতিবিদদের যে একটা কর্তৃত্ব বা কাজ আছে, এতে কিন্তু তা ম্লান হয়ে যায়। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে (রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম) এমপিরা সচিবদের ওপরে।

আমরাও মন্ত্রী ছিলাম। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমি শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী ছিলাম। আমারও দায়িত্ব ছিল একটি জেলায়। তখন মন্ত্রীরা জেলার দায়িত্ব পালন করতেন। একটি জেলায় মন্ত্রীরা গেলে নেতাকর্মীরা আসতেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা হতো। আমরা গ্রামে-ইউনিয়নে সব জায়গায় যেতাম। কোথায় যেন সেই দিনগুলো হারিয়ে গেছে।’

কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘প্রতিটি জেলার রাজনৈতিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। প্রধানমন্ত্রী ডিসি সাহেবদের সঙ্গে কথা বলেন আর এমপিরা পাশে বসে থাকেন। এমপিরা বলেন, ডিসি সাহেব, আমি একটু কথা বলব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।

এই হচ্ছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যখন ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেন, তখন এমপিদের কোনো দাম থাকে না। রাজনীতি না থাকায় রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করেছে। ব্যবসায়ীদের হাতে তো ব্যবসার চালিকাশক্তি ছিলই।

অর্থনীতির চালিকাশক্তি তাদের কাছে। এখন রাজনীতিও তাদের হাতে। এখন দেশ চালাচ্ছে জগৎ শেঠরা, দেশ চালাচ্ছে আমলারা। আমরা রাজনীতিবিদরা এখন তৃতীয় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এ হচ্ছে আমাদের দুর্ভাগ্য।’ আলোচনায় অংশ নিয়ে আমলাতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির ডা. রুস্তম আলী ফরাজীও।

এখানেই শেষ নয়, উপজেলা পর্যায়ে প্রধান নির্বাহীর (সিইও) দায়িত্ব পালন করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। এখনেও সংসদ সদস্য ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের ভূমিকা গৌণ। আর এখন পৌরসভার প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার যা অস্বস্তি তৈরি করেছে পৌর মেয়রদের মধ্যে।

ঢাকার দুই সিটিসহ ১২টি সিটি কর্পোরেশনের সিইও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এখন ১৯৪টি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভার সিইও নিয়োগ দেওয়া হবে। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসেসিয়েশনের সভাপতি হারুন অর রশীদ ক্ষোভ ঝেড়ে বলেছেন, ‘আইন ও সংবিধানে আছে উপজেলা চেয়ারম্যানেরা উপজেলার প্রধান নির্বাহী।

কিন্তু পরিপত্র জারি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রধান নির্বাহী করা হয়েছে। আর এর প্রতিবাদ করলে, রাজপথে নামলে আমাদের বলা হয় আমরা সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করছি।’ তিনি বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ বাদ দিয়ে নির্বাহী কর্মকর্তারা বলছেন এখন উপজেলা প্রশাসন।

কিন্তু প্রশাসন হবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অধীন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বেই প্রশাসন পরিচালিত হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। এবং এটা করোনার চেয়েও ভযাবহ।’ কিন্তু কেন এই আমলা নির্ভরতা? : একজন সাবেক সচিব আমলা নির্ভরতার পেছনে চারটি কারনের কথা উল্লেখ করেছেন।

এক. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার দলের সিনিয়র নেতাদের আস্থায় নিতে পারছেন না। এ কারণে অনেক সিনিয়র নেতারা মন্ত্রীর দায়িত্ব পাননি।

দুই. দলের অনেক জুনিয়র নেতাদের মন্ত্রীসভার সদস্য করা হয়েছে; তাদেরও খুব আস্থায় নিতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী।

তিন. জাতীয় সংসদ সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেনি। সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রভাব বেশি। চার. গত দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে নানা বির্তক রয়েছে। অনেকে এটা ভোটারবিহীন নির্বাচন বলে মনে করেন। এসব কারণে আমলাদের উপর নির্ভরতা বেড়ে থাকতে পারে।

আর আমলা নির্ভরতা কেন বাড়ছে- তা রাজনীতিবিদদের চিন্তা করতে হবে। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী না থাকলে, নির্বাচন নিয়ে বির্তক থাকলে তা জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য হয় না। এ ধরণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রতি জনগনের আস্থা থাকে না। সাবেক এই সচিবের নাম আবু আলম মো. শহীদ খান।

আমলা নির্ভরতা প্রসঙ্গে আরেক সবেক আমলা (সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব) আলী ইমাম মজুমদারের বক্তব্য হলো- ‘ পর পর দুটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ নির্বাচনকে ভোটারবিহীন নির্বাচন বলে অনেকে আখ্যা দিয়েছেন।

এ ধরণের নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেই। এ কারণেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
কিন্তু আমলা নির্ভরতা নিয়ে এই দুই আমলার যুক্তি কতটা যৌক্তিক? দুইজনেই বলছেন, ‘ভোটার বিহীন নির্বাচনের মধ্যদিয়ে এমপি হয়েছেন বলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ তাই যদি হয় তাহলেতো

প্রধানমন্ত্রীর ওপরও আমলাদের আস্থা থাকার কথা না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীই নাকচ হয়ে যান। কিন্তু তা কী দেখা যাচ্ছে? প্রধানমন্ত্রীর হুকুম পালনের জন্যতো আমলারা সারারাত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে প্রস্তুত। অর্থাৎ ভোটারবিহীন নির্বাচনের কারণে এটা হয়েছে সে যুক্তি টিকে না।

‘প্রধানমন্ত্রী হয়তো সিনিয়র নেতাদের আস্থায় নিতে পারছেন না’- আবু আলম শহীদ খানের এই যুক্তির পেছনের করাণ হতে পারে সিনিয়র নেতারা দুর্নীতিবাজ কিংবা অযোগ্য। যদি তাই হয় তাহলে এই দোষে দুষ্ট গোটা আমলাতন্ত্র। দুর্নীতি আমলাতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

এই আমলাদের বিরুদ্ধেই বিদেশে টাকা পাচার করে বেগম পড়ার বাসিন্দ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই আমলারাই মুক্তিযোদ্ধার ভূয়া সার্টিফিকেট নিয়ে বাড়তি বয়সের সুবিধা নিয়ে সচিব হয়েছেন। এছাড়া গত কয়েক বছরে আমলাদের অপকর্মের খতিয়ান জাতীয় বিভিন্ন পত্রিকাগুলো ঘাটলেই পাওয়া যাবে।

কাজেই আমলারা ধোয়া তুলসিপাতা; আর সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী তাদের ওপর আস্থা রেখেছেন- এ কথা বলার সুযোগ নেই। এখন যদি প্রধানমন্ত্রী পরিপত্র জারি করে এমপিদের জেলার দায়িত্ব দেন কিংবা অন্যান্য কাজে সম্পৃক্ত করেন- তাহলে কী বলবো, আমলাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আস্থা কমে গেছে? এটাও কিন্তু বলা যাবে না।

আর তোফায়েল আহমেদ রাজনীতিবিদদের ক্ষমতা ম্লান হওয়ার যে অভিযোগ এনেছেন তাও সঠিক নয়। কারণ আমলারা এখন যার হুকুমে ওঠবস করেন- সেই প্রধানমন্ত্রী কিন্তু রাজনীতিক। রাজনীতির সব শক্তি এখন শেখ হাসিনার হাতে কেন্দ্রীভূত।

এ কারনেই তার হুকুমে সব চলছে। কাজেই রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব ম্লান হয়েছে এ কথা বলা যাচ্ছে না। তবে ক্ষমতার এ ধরনের এককেন্দ্রীকতা নিশ্চই ভাল লক্ষণ নয়।

প্রশ্ন হলো- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেনো আমলাদের এতো গুরুত্ব দিচ্ছেন? এই প্রশ্নের অনুমান নির্ভর অনেক উত্তর আছে। তবে সেদিকে না গিয়ে এটুকু বলা যায়, সরকার পরিচালনায় তিনি যে নীতি নিয়ে এগুচ্ছেন তা নিজের রাজনীতি তথা দেশের জন্য ভাল কিছু বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। সূত্র : ফেসবুক Mamun Farajee

কর্তৃত্বম্লানরাজনীতিবিদদের
Comments (0)
Add Comment