‘দেশে প্রবীণ কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদক চলে গেলেই বলা হয়, ‘এ শূন্যতা পূরণ হওয়ার মতো নয়’। সত্যিই ভালো সাংবাদিকতায় ভয়াবহ শূন্যতা (সংকট) সৃষ্টি করে একে একে গত হয়েছেন, হচ্ছেন বহু ‘বরেণ্য’। যদিও পঞ্চাশ-ষাট দশকের রাজনৈতিক সাংবাদিকতা আধুনিক সময়ে একেবারেই অনুপযোগী। বরং সংকটটা আশি-নব্বই দশকের সাংবাদিকদের নিয়ে। যাদের ভিত রাজনৈতিক, বিস্তার করপোরেটে, অর্জন ডিজিটালে। তাদের অনেকে ব্যবস্থাপনায় ব্রিটিশ মানসিকতা বহন করায় তামাদি হয়েও সিন্ডিকেটভিত্তিক ‘বরেণ্য’। আবার সেই তাদের হাত ধরেই ‘নবযাত্রায়’ অনেকে পদে পদে ব্যর্থ-নিন্দিত হয়ে কুড়াচ্ছেন বিবর্ণ ফুল।
এমন ‘ইন্ট্রো’ লেখার কারণ, সম্প্রতি বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমকে আলোর মুখ দেখার আগেই ঘন অন্ধকারে তালিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, সেকেলে দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ব্যর্থ হচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদকেরা। অনেকে বলছেন, ‘খাড়া হওয়ার আগেই মাজা ভাঙছে’। অথচ ‘মন্দায় বিনিয়োগ বাড়াও’ নীতিতে বহু উদ্যোক্তা বড় বড় বিনিয়োগ নিয়ে হাজির হচ্ছেন সংবাদমাধ্যম শিল্পে। তবে টেকসই মডেলের সম্পাদক খুঁজতে গিয়ে বার বারই হতাশ হচ্ছেন।
তরুণ সংবাদকর্মীদের ভাষ্য, ভালো সম্পাদক হওয়ার চেয়ে এখন দাপুটে সাংবাদিক নেতা হওয়া বেশি সম্মানজনক। লাভজনক তো বটেই। তাই সম্পাদক হয়ে ওঠার দৌড়ে সবাই পেছনে। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সম্পাদক মূর্খের মতো রগচটা, মাথাগরম, অসৃজনশীল, মনস্তাত্ত্বিকভাবে জটিল-কূটিল। তারা সংকট উত্তরণের পথ হিসেবে শ্রমশোষণকেই বেছে নিচ্ছেন। অফিসে কর্মীঘনত্ব কমাতে প্রবল মানসিকচাপ সৃষ্টির কৌশল করছেন। যাতে ভেঙে পড়ছে নবাগত-সাবেক সব সংবাদমাধ্যমের ব্যবস্থাপনা কাঠামো। ব্যর্থ হচ্ছে বিপুল বিনিয়োগ।
অন্যদিকে, সাংবাদিকতায় মেধাবীদের অণুপ্রবেশ ঘটাতে বিসিএসের মতো পরীক্ষা আয়োজনের তাক লাগানো উপায় বের করছেন কেউ কেউ। সরকারি-বেসরকারি বহু সংস্থা সংবাদকর্মীদের উচ্চমার্গীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বগলও বাজাচ্ছে। সাংবাদিকতা বিভাগে টানতে শিক্ষার্থীদের ‘মহান পেশা’র আফিম গিলিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও। তবে এতকিছুর পরও কলঙ্ক (সাংঘাতিক!) ঘুচছে না।
অনেকে চরম অসহিষ্ণু হয়ে অসংসদীয় আলোচনায় প্রশ্ন তুলছেন, বুদ্ধিবৃত্তিভিত্তিক সাংবাদিকতায় আধুনিক যুগে ট্রেড ইউনিয়নের দরকার কী? প্রচলিত আইনই বড় সুরক্ষক। তাহলে দেশের সব প্রেস ক্লাব আর সাংবাদিকদের সংগঠন ভেঙে দিলেই তো আবর্জনা-পঙ্কিলতা দূর হয়। পরিবেশ কলুষমুক্ত করতে পারলেই যুগোপযুগী টেকসই সম্পাদক তৈরি হবে। মেধাবীদের আগ্রহ বাড়বে।
জরিপ বলছে, বিকল্প কোনো উপায় থাকলে অন্তত ৮০-৯০ ভাগ সাংবাদিক তাদের পেশা ছাড়তেন। এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যেও অবিশ্বাস্যভাবে সংবাদমাধ্যমে বিনিয়োগ বেড়েই চলছে। অথচ সেই বিস্ময়কর বিনিয়োগ সফল করার ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা টেকসই সম্পাদকের অভাব। অবশ্য এমন দুঃসময়েও বিনিয়োগকারীদের কবজা করে কেউ কেউ নতুন সংবাদমাধ্যমের নবযাত্রা ঘটাচ্ছেন। তবে তাদের ‘ব্যাকডেটেড’ দৃষ্টিভঙ্গি আর সোনালি দিনের স্মৃতির আফিমে আসক্তি বিপুল পরিমাণ ‘নির্মোহ’ বিনিয়োগকে প্রবল ঝুঁকিতে ফেলছে।
তবে এটাও সত্য, প্রতিশ্রুতিশীল কিছু তরুণের হাত ধরে আধুনিক ধারার সংবাদমাধ্যমে টেকসই বিজনেস মডেল তৈরি হচ্ছে। তারা বাকসর্বস্ব, শ্রমশোষক, ব্রিটিশ মগজের অধিকারী, অভিজাতধারার জটিল বরণ্যেদের বিপরীতে নিজেদের অবস্থান টেকসই করছেন। দিন দিন আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন। এই তরুণ সম্পাদকেরাই সক্ষম হতে পারেন সাংবাদিকবান্ধব বিনিয়োগকারীদের মুখে হাসি ফুটিয়ে নতুন ধারা তৈরিতে। সে পর্যন্ত সাংবাদিকতার অদ্ভুদ আঁধারেই হাঁটতে হবে আমাদের।
লেখক : গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক
ইবাংলা / টিপি/ ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১