মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে গত বছর ১৩ জুন রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও চার মন্ত্রণালয়ে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করা জাতীয় নেতা এম মনসুর আলীর সুযোগ্য সন্তান মোহাম্মদ নাসিম।
এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবীদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে তার পরিবার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এছাড়াও তার জন্মস্থান সিরাজগঞ্জের কাজিপুরে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা করা হচ্ছে।
১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। ২০১৪ সালে সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। এর আগে স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সবশেষ ২০১৮ সালেও একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মোহাম্মদ নাসিম বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন ১৪ দলের মুখপাত্র।
রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে গত বছরের ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন মোহাম্মদ নাসিম। ওই দিনই তার করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার কথা শোনা গেলেও পরপর তিনবার নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস পাওয়া যায়নি তার শরীরে। এরপর ৪ জুন তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ৫ জুন ভোরে তিনি স্ট্রোক করেন।
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে তাকে আইসিইউতে রাখা হয়। এরপর দুই দফায় ৭২ ঘণ্টায় করে পর্যবেক্ষণে রাখে মেডিকেল বোর্ড। কয়েক দিন স্থিতিশীল থাকলেও ১৩ই জুন বেলা ১১টার দিকে না ফেরার দেশে চলে যান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম।
১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ নাসিম। তার পিতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। মোহাম্মদ নাসিম ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজনীতির মাঠে রেখেছেন বাবার মতোই সাহসী ভূমিকা।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল হওয়ার কারণে কারাগারে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ দিতে হয়েছিল বাবা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীর। এরপর বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে রাজনীতি করেছেন নাসিমও।
ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বিভিন্ন আন্দোলনে রাজপথে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। পিতার মতো তিনিও দেশের রাজনীতিতে একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।
ছাত্ররাজনীতি ছাড়ার পরে যুবলীগের রাজনীতি করলেও ১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মোহাম্মদ নাসিম। ওই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন।
২০০২ সালের সম্মেলনের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছিলো একটি। আর ওই সম্মেলনে বিভাগওয়ারী সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর আগে ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে মোহাম্মদ নাসিমকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। দায়িত্ব পালনে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন।
পরে ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। এরপর ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এরপর টানা তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন।
রাজনৈতিক মাঠে সুবক্তা হিসাবে পরিচিত মোহাম্মদ নাসিম ভোটের রাজনীতিতেও সফল হিসেবে পরিচিত। ১৯৮৬ সালে তিনি প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজগঞ্জ- ১ সংসদীয় আসন (কাজীপুর) থেকে পাঁচবার বিজয়ী হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে তাকে স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়।
২০১৪ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ১/১১ সরকারের দেয়া মামলার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ওই নির্বাচনে তার সন্তান তানভীর শাকিল জয়কে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ নাসিমকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। বিজয়ী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে।
রাজনৈতিক জীবনে মোহাম্মদ নাসিম বিভিন্ন সরকারের সময় জেল, জুলুম ও নির্যাতন ভোগ করেছেন। পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনসহ স্বাধীন বাংলাদেশে সকল সামরিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে রাজপথের সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।
মোহাম্মদ নাসিম ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। দেশের সকল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অংশ নেন। রাজনৈতিক দুরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার কারণে তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন।
সারাবিশ্বে এখন করোনাভাইরাসের সংকট চলছে। বাদ নেই বাংলাদেশও। মোহাম্মদ নাসিম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় করোনাকালে সিরাজগঞ্জে মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। সরাসরি মানুষের খোজ নিয়েছেন।
কিন্তু দেশের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম অসময়ে চলে গেছেন কর্মী সমর্থকদের কাঁদিয়ে। তবে তিনি এদেশের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। বেঁচে থাকবেন দেশের রাজনীতিতে। কারণ তিনি রাজনীতিতে কিংবদন্তি ছিলেন। তার মধ্যে ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ৷ তিনি কখনোই অপশক্তির কাছে মাথা নথ করেননি।
ই বাংলা/ ইস্রাফিল/ ১৩ জুন, ২০২১