শুরুতেই রইল নতুন বছরের শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ। সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় আমরা নতুন একটি বছরে প্রবেশ করছি, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহপাক কুরআন কারিমে ইরশাদ করেন: ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)।
আল্লাহতায়ালা আরো ঘোষণা করেন: ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের মঞ্জিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন’ (সুরা ইউনুস, আয়াত: ৫)।
সাধারণত দেখা যায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে লোকেরা হৈ-হুল্লোড় ও ক্রীড়া-কৌতুক আর জাগতিক আনন্দ উল্লাসের মাঝে সারা রাত কাটিয়ে দেয় আর এতে এমন কোন অপকর্ম নেই যা পাশ্চাত্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে না করা হয়।
আমাদের নিজেদের কর্ম নিয়ে একটু তো চিন্তা করা উচিত যে, আমরা কি করছি? যেভাবে ইসলামী জাহানের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) একবার মিম্বরে দাঁড়িয়ে তার খুতবায় এক ঐতিহাসিক উক্তি উপস্থাপন করেছিলেন, যা ইমাম তিরমিজি (রহ.) স্বীয় গ্রন্থ তিরমিজি শরিফ এবং ইমাম ইবনে আবি শায়বা (রহ.) স্বীয় গ্রন্থ মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বায় উল্লেখ করেন।
হজরত ওমর (রা.) বলেছিলেন, ‘হিসাব চাওয়ার আগে নিজের হিসাব করে নাও, তোমার কাজ পরিমাপ করার আগে নিজেই নিজের কাজের পরিমাপ করে নাও’ (জামে তিরমিজি)।
অথচ আমরা এটি ভেবে দেখি না যে, জীবন থেকে একটি বছরের সমাপ্তি ঘটছে আর প্রবেশ করছি নতুন বছরে, যেখানে আমার করণীয় হল সৃষ্টিকর্তার দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, নিজের ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, নতুন বছর যেন সর্বদিক থেকে মঙ্গলময় হয় সেই দোয়া করা। অথচ তা না করে আমরা সব ধরণের বৃথা কার্যকলাপ এবং অপকর্ম করে নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছি।
নববর্ষের মতো সময়ের একটি এহেন গুরুত্বপূর্ণ পর্বে এমন কোনো কাজ করা সমীচীন হবে না, যা আমাদের আমলনামা বা জীবনপঞ্জিকে কলঙ্কিত করবে। হজরত আলী (রা.) বলেন: তুমি রাতের আঁধারে এমন কোনো কাজ করো না, যার কারণে তোমাকে দিনের আলোয় মুখ লুকাতে হবে। আসলে আজ পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির ধর্মের চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই তাদের দৃষ্টি সেখানে পৌছা সম্ভব নয় যেখানে একজন মুমিনের দৃষ্টি পৌছে।
একজন মুমিনের মহিমা হল এই সমস্ত বৃথা কার্যকলাপ এড়িয়ে চলা, বরং আত্মজিজ্ঞাসা করা যে, আমাদের জীবনে একটি বছর এসেছে এবং চলে গেছে, এই বছরটি আমাদের কী দিয়ে গেল বা কি নিয়ে গেল আর আমরা কি পেলাম আর কি হারালাম?
একজন মুমিন এটাই দেখবে যে, জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ বছর সে কী হারিয়েছে আর কি পেয়েছে? তার জাগতিক অবস্থা বা বৈষয়িক অবস্থায় কি ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। সে বিগত বছরে কি কি পুণ্যকর্ম করেছে আর এবছর যেন আরো বেশি পুণ্যকর্ম করতে পারে সেই চেষ্টায় সে নতুন বছরকে বরণ করবে তাহাজ্জুদ নামাজ এবং বিশেষ ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে।
আমাদের দুর্বলতার জন্য মহান আল্লাহপাকের দরবারে এই দোয়া করতে হবে, হে আল্লাহ! আমাদের আগত বছর যেন বিগত বছরের ন্যায় আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে দুর্বল না হয় বরং আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ ও পদচারণা যেন তোমার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হয়।
আমাদের প্রতিটি দিন যেন বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শে অতিবাহিত দিন হয়। আমরা যেন পবিত্র কোরআন এবং প্রকৃত ইসলামের শিক্ষানুসারে জীবন পরিচালনা করতে পারি। এই দোয়া যদি আমাদের হয় আর আমরা যদি নববর্ষের সূচনায় আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মবিশ্লেষণ করি তাহলে আমাদের পরিণতি অবশ্যই শুভ হবে।
হজরত ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর দাদা তার পিতাকে পারস্যের নওরোজের দিন অর্থাৎ নববর্ষের দিন হজরত আলী (রা.)-এর নিকট নিয়ে গিয়েছিলেন এবং কিছু হাদিয়া পেশ করেছিলেন। তখন হজরত আলী (রা.) বললেন, ‘নওরোজুনা কুল্লা ইয়াওম’ মুমিনের প্রতিটি দিনই তো নববর্ষ। অর্থাৎ মুমিন প্রতিদিনই তার আমলের হিসাব নিকাশ করবে এবং নবউদ্যমে আখেরাতের পাথেয় সংগ্রহ করবে।
আমাদের বছর যদি শুরু হয় উত্তম কাজ দ্বারা আর আল্লাহপাকের কাছে কামনাও থাকে যে, সারা বছরই যেন আমাকে ভালো কাজের তৌফিক দান করেন তাহলে অবশ্যই আমার জীবন হবে শান্তি ও কল্যাণময়।
আমাদেরকে জাগতিকতার আনন্দ উল্লাসে ডুবে না গিয়ে মহান আল্লাহর স্মরণে বছরের সূচনা করতে হবে এবং সারা বছরই যেন আমার দ্বারা কোন অন্যায় কাজ সংঘটিত না হয় তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে আর তবেই না আল্লাহপাক আমাদের ছোটখাট ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহতায়ালা নতুন বছর দেশ, জাতি এবং গোটা বিশ্বের সবার জন্য অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
ইবাংলা / নাঈম/ ০১ জানুয়ারি, ২০২২