মামার উদ্দেশ্যে ভাগিনার খোলা চিঠি

এ বি সিদ্দিক

মামা,
অসুস্থতার কারনে দীর্ঘদিন ধরে বেড রেস্টে। একই সঙ্গে কঠোর নজরদারিতে। যেন বুনো হাতি গর্তে পড়লে উইপোকাও যে চেপে ধরে, আমার অবস্থাও তাই হয়েছে। এ সময়ে নিজেকে অনুভূতিহীন বন্দী কয়েদীর মত মনে হতো। তবে সেবা-যত্নে কোন ভাটা পড়েনি। বন্ধুমহলের দোয়া ও আশীর্বাদ, পাঠক ও ভক্তকুলের নির্ভেজাল ভালোবাসা, সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে কিছুটা সুস্থতা লাভ করেছি। এই একাকীত্ব ও কর্মবিমূখ জীবনে নিজেকে অসহায় মনে করতাম। এ সময়ে মিতালী মুখার্জির কন্ঠে গাওয়া যে গানটি মনকে বেশ নাড়া দিত তা হলো,
“জীবন নামের রেলগাড়িটা
পায়না খুজে স্টেশন।
কোন লাইনে গেলে পাবে
বলবে কারে কে এখন।”

মামা,
সাপ যখন জীবিত থাকে, তখন সে পিঁপড়া খায়। আবার সাপ যখন মারা যায়, তখন পিঁপড়া সাপকে খায়। একটি গাছ দিয়ে যেমন কয়েক লাখ ম্যাচের কাঠি তৈরী করা যায়, তেমনি একটি ম্যাচের কাঠি দিয়ে কয়েক লাখ গাছ পুড়িয়ে দেওয়া যায়। সবসময় সবার সুদিন থাকে না। সময় একদিন বদলায়। বদলাবেই। দিনশেষেই রাত্রি অবধারিত। সব অভিনেতাই একসময় মঞ্চ থেকে অপসৃত হয়। মনে রাখতে হবে, তুমি যতটা মূল্যবান, ততটাই সমালোচনার পাত্র। ভুল করা দোষের নয় বরং ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা দোষণীয়। অনেকেই বোঝেনা।অনেকেই বুঝেও না বুঝার ভান করে। এমনকি ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করে। যার পরিনাম ফল শুভ হয়না।
মামা,
আমার এ পত্রালাপ দীর্ঘদিনের। তবে এগুলো স্বযতনে রেখে দিও। মানুষের জীবনের ঘটনা প্রবাহ একেকটা চিঠির মতই। কিছু চিঠি আগলে রাখতে হয় গোটা জীবন। আর কিছু চিঠি পড়ার পর ছিঁড়ে ফেলে দিতে হয়। মুন্সীগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা তানেস উদ্দিন আহমেদ আজ পঞ্চাশ বছর যাবত তার প্রেমিকা জোহরার চিঠি ও ছবি পকেটে নিয়ে ঘুরছেন। দেশ স্বাধীন করে জোহরাকে বিয়ে করার কথা। কিন্তু যুদ্ধের সময় জোহরা ও তার বাবাকে দুষ্কৃতিকারীরা হত্যা করে। চিঠি আর ছবি নিয়ে তানেসউদ্দিন আহমেদ এখনো জোহরার স্মৃতিকে মনের আর্কাইভে ধারণ করে চিরকুমার হিসেবে বেঁচে আছেন। লেখক নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব উপন্যাসকে বাঙ্গালীর প্রেমানুভূতির আদর্শ মনে করা হয়। লেখক গল্পকথকের বৌদিকে লেখা মোট ২০ টি পত্রের সংকলন পুরো উপন্যাস, যা বাংলা সাহিত্যের পত্র উপন্যাস নামে খ্যাত। আদ্যোপান্ত চিঠি দিয়ে একটি উপন্যাস।

মামা,

তোমার কাছে লেখা আমার সকল আবেগ অনুভূতি কোন উপন্যাস থেকে কম ভেবো না। আবেগে তাড়িত না হয়ে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে লেখার বিষয়গুলোকে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে নিও। বিশ্বাস করো বা নাই করো, চিঠির ভাষা কখনো কখনো বিপর্যস্ত মন মানসিকতাকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে। প্রেরনা ও সাহস যুগিয়ে কর্ম উদ্দীপনা বাড়িয়ে দিতে পারে।

মামা,

ইংরেজ এদেশের মানুষকে পায়ের নিচে রাখত। পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী শাসনের নামে শোষণ করত।
বাঙ্গালীদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করত এবং দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করত। আর আমরা এখন
বড়লোকদের মাথায় করে রাখছি। কালোবাজারি, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, দখলবাজ, অসাধু ব্যবসায়ীদের জোড় হাতে অনুষ্ঠানে কিংবা প্রতিষ্ঠানে সভাপতির আসনে আহবান করছি। ইংরেজ এদেশের ধন সম্পদ লুট করত। পাকিস্তানীরা বৈষম্য আর বিভাজন সৃষ্টি করে ধনসম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করত। আর আমরা এখন দেশ বিক্রি করে দিচ্ছি। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছি। কানাডার বেগম পাড়ায় আলীশান বাড়ি করে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে আমোদপূর্তিতে মেতে আছি। মামা জেনে রাখা ভালো, দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপী ঋণ এখন ১লাখ কোটি টাকার উপরে। এর বিরাট একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির মতে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে [ওভার ইনভয়েস আন্ডার
ইনভয়েস]

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৬বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশের মুদ্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। এ অর্থ দিয়ে কয়েকটি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল করা যেতো। আমরা জনশক্তি রপ্তানির নামে মানব পাচার করছি, দেশের মান ক্ষুন্ন করছি। অর্থ ও মানব পাচারের দায়ে বিদেশের কারাগারে কারাভোগ করছি,দেশের ইজ্জত নষ্ট করছি।

মামা,

নানা অসংগতি, অবিচার, অনাচার, অসহিষ্ণুতা, অনাধিকার চর্চা, অনিশ্চয়তা ও নীতিহীনতা নিরাপত্তাহীনতা, উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা, বিমুগ্ধতা, ধর্মান্ধতা, অপসংস্কৃতি, অপরাজনীতি,অপবাদ- অপরাধ, বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্যে সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সাধু শয়তান, তোষামোদকারী আর বর্ণচোরাদের কর্মকাণ্ডে মানুষ অতিষ্ঠ। কাকে বলবো কিভাবে বলবো কে শুনবে আমার কথা। যেনো অরণ্য রোদন ছাড়া আর কিছু নয়। কথায় বলে,
“যৌবনে কাকও সুন্দরী,
শ্রাবণে নদীও কুমারী।
ক্ষমতা থাকলে মিথ্যা কথাও বাণী,
শক্তি আর টাকা থাকলে মূর্খও জ্ঞানী।”

ক্ষমতার ছায়াতলে বা আশেপাশে থাকলে যুক্তি আর তর্ক দিয়ে মিথ্যাকে সত্য বলে চাপিয়ে দিয়ে আত্মস্বীকৃত পন্ডিত বা মহাজ্ঞানী ভাবা সহজ হয়। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সর্প হয়ে দংশন আবার ওঝা হয়ে ঝাড়া হয়। বিচিত্র এ দেশ। এরই মাঝে আমরা সমুদ্রের চোরাবালির মতো টিকে আছি যা শুধুমাত্র নিরাপদ জীবন আর নিরাপদ সমাজের আশায়। দেশে চলছে টাকার শাসন। উন্নতির জন্য জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না, জ্ঞান বরং বোঝা হয়ে দাড়ায়। সুস্থ এবং সমাজ পরিবর্তনমূখী সংস্কৃতি চর্চার ভীষণ অভাব। সমাজিকতা কোনঠাসা হয়েছে। বিনোদনের জন্য মানুষ সামাজিক পরিসরে মিলিত হয় না,ঘরের অন্ধকারে বসে শুধু বোতাম টিপাটিপি করে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে কিশোর গ্যাং। বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ দিশেহারা। এতে দেশের নাগরিকেরা কেমন আছে তা প্রবৃদ্ধির রাঙতার ঝিলিকে অন্ধচোখে ধরা পড়েনা। রাঙতার কাগজের একদিকে থাকে সোনালী -রূপালী প্রলেপ, অন্যদিক টা মলিন। মলিন দিকটাতে বসবাস সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে গণপরিবহন মালিক বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দিল। প্রভাবিত হলো কৃষক শ্রমিক জনতা। বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়াকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। আমাদের সরকার গুলো জনগণের কথা শুনেনা, শুনে মালিক শ্রেনীর কথা, আর শুনে রূপসী কিশোরীর মতো শুধু প্রশংসা।

মামা,

আমাদের বাড়ীর পশ্চিমপাড়ে হিন্দু পরিবার পেশায় কর্মকার, পূর্বপাড়ে আমরা মুসলিম পরিবার,
হিন্দু মুসলিম মিলে-মিশে আছি এপার-ওপার। মিলনের অপূর্ব নিদর্শন যেন এক একান্নবর্তী পরিবার।

বছরের পর বছর আমরা এভাবে বসবাস করে আসছি। পূজাপার্বন, বিবাহ অনুষ্ঠান, সামাজিক সমাবেশ বা খেলাধুলায় হিন্দু মুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই।
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম……।
আমাদের কর্মকাণ্ড চলাফেরা ওঠাবসায় গানের কথাগুলোর মতই। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হিন্দুরা ধনসম্পদ রেখে ভারতে চলে যায়। মুসলমানেরা তাদের ধনসম্পদ রক্ষায় এগিয়ে আসে। এমনকি তাদের কাছে গচ্ছিত টাকা-পয়সা স্বর্ণালংকার দেশ স্বাধীনের পর কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেয়। বিবাদ বা বিরোধ চোখে পড়েনি।

শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে হিন্দু শিক্ষকদের সম্মান এবং গ্রহনযোগ্যতা ছিলো
আকাশচুম্বী। প্রাইমারী লেভেলের বিধুস্যার, মাধ্যমিকের ইংরেজির অমৃত বাবু, বাংলার রেবতীমোহন দাস, অংকের বিএসসি বাবুর শিক্ষাদান প্রদ্ধতি ছিল অসাধারণ। ছাত্রদের কাছে ছিল প্রিয়পাত্র আর নির্ভেজাল স্নেহমমতায় ভরপুর। বন্ধু দুলালকান্তি চক্রবর্তীর শেখা বিবাহমন্ত্র আর আশুতোষ ভট্টাচার্যের রাশিফল গণনার কলাকৌশল এখনও রপ্ত আছে। জাতীয় প্রেসক্লাবে চীফ অফিসারের দায়িত্ব পালন কালে বিজ্ঞ অভিজ্ঞ দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিকদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ভিন্নমতের হলেও মেলামেশায় আচার-আচরণে হিন্দু মুসলিম সাংবাদিকদের মধ্যে অন্য রকম সখ্যতা বিরজমান। অসম্প্রদায়িক চেতনার অপূর্ব মিলন ক্ষেত্র সাংবাদিকদের দ্বিতীয় গৃহ জাতীয় প্রেসক্লাব। জাতীয় প্রেসক্লাবের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের ট্রেজারার পদে ক্লাব সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত বাসসের স্বপন কুমার সাহা (পরবর্তীতে দুই দুইবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক) সংবাদের কার্তিক চ্যাটার্জি এবং ভোরের কাগজের শ্যামল দত্ত। এই তিন জন গুণী সাংবাদিক প্রেসক্লাবের ট্রেজারার পদে থাকা অবস্থায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বুনিয়াদ সুদৃঢ়করণের
পাশাপাশি ব্যয় সংকোচন করে নিজেদেরকে সততা ও নিষ্ঠার এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হলো এ সম্প্রদায়ের কিছু লোকের লাগামহীন দূর্নীতি আর অপকর্মের কারণে জনমনে যেমন বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনিভাবে এদের অপকর্মের দায়ভার থেকে কমিউনিটিও রেহাই পাচ্ছে না।
পিকে হালদার(প্রশান্ত কুমার হালদার) বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১০হাজার কোটি টাকা লোপাট ও পাচার করে কানাডার টরেন্টো পাড়ি দিয়েছেন,গড়ে তুলেছেন বাড়ি-গাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তার বিরুদ্ধে রয়েছে অসংখ্য মামলা,অর্ধডজন আর্থিক প্রতিষ্ঠান কে পথে বসিয়েছেন। লুট করা টাকা কানাডা, সিংগাপুর,ভারতে পাচার করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস.কে সূর চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ যা মিডিয়াতে তোলপাড়।
ডাকবিভাগের মহাপরিচালক সুধাংসু শেখর ভদ্র বিভিন্ন প্রকল্পে কেনাকাটায় এবং ল্যাপটপ সরবরাহ না করে বিল ভাউচারের মাধ্যমে ও ঠিকাদারি কাজের মাধ্যমে অনিয়ম করে ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। দূর্নীতির অভিযোগে তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে দেওয়া হয়। মেজর সিনহা হত্যার অন্যতম আসামী ওসি প্রদীপ কুমার সিংহ রায়ের তিনশত কোটি টাকা দূর্নীতির অভিযোগের গল্প কাহিনী সর্বত্র সমালোচিত। এদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য দেশ-জাতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত তেমনি পুরো কমিউনিটি ভাবমূর্তি হারাচ্ছে। তারপরও বলব এদেশের শিক্ষা সংস্কৃতি ও সাহিত্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের অসংখ্য পন্ডিতের অবদানের কারণে সাহিত্য সংস্কৃতি বিস্তৃতি লাভ করেছে এবং করছে। কবিগুরু রবিঠাকুর, জীবনানন্দ দাস,শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র,মাইকেল মধুসূদন দত্ত,সুকুমার রায়,তারাশঙ্কর বন্ধ্যোপধ্যায় সহ অসংখ্য কবি সাহিত্যিকের লেখা কবিতা গান, উপন্যাস গল্প প্রবন্ধ আমাদের জ্ঞানের প্রসারতা বৃদ্ধি করেছে। অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক,রাজনীতিবিদ, শিল্পী,অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাংবাদিক ও ক্যাডার অফিসার কর্মকর্তাদের অবদান দেশকে অনেক এগিয়ে দিয়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এদেশের সম্পদ। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের একটি ফসল হিসাবে রবিঠাকুরের আমার সোনার বাংলা গানটি এসেছিল। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী একটি সভায় এই গান প্রকাশ করেন এবং গেয়ে শোনান তিনি। ১৯৭২ সালে এ গানকে জাতীয় সংগীত হিসাবে বেছে নেয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন অসম্প্রদায়িক চেতনার একটি মডেল।

মামা,

১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়া দীঘির পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে ন্যাক্কারজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে
(মন্দিরে পবিত্র কোরান শরিফ রাখার কারণে) দেশের ২৭টি জেলায় হামলা হয়েছে। এ সময় ১১৭টি মন্দির পূজামণ্ডপ ভাংচুর হয়েছে। ৩০১ টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এবং বসতবাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক হামলায় ৯ জন নিহত হয়েছেন এর মধ্যে ৪জন পুলিশের গুলিতে।হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত এ তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন। এটি কোন ভাবঘুরের কাজ হতে পারে না,এটি পূর্বপরিকল্পিত ঘটনা। চক্রান্তকারীরা পেছনে আছে,এদের বের করা রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব বলে মন্তব্য করেন (প্রথম আলো ২২ অক্টোবর ২০২১)। সরকার সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাদানে ব্যর্থ হয়েছেন বলে দুটি জেলার পুলিশ সুপার সহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি ও প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। প্রশাসন তদন্তে আস্থা রাখতে পারেনি বলে সংখ্যালঘুদের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনুপকুমার সাহা ও মিন্টু চন্দ্র দাস বিচারিক তদন্তের দাবী করে হাইকোর্টের রীট করেন। উচ্চ আদালত তা আমলে নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দেন। বিরোধীরা সরকারের সাজানো নাটক বলে মন্তব্য করলেও আসলে ২০০১ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন, রামুর ঘটনা, নাসির নগরের তান্ডবের বিচার না হওয়ার কারনে হোতারা ধরা ছোয়ার বাইরে ফলে এসব ঘটনা বারবার ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞগন মনে করেন। পাকিস্তান আমলে ও শাসক গোষ্ঠী রবীন্দ্র সংগীত বন্ধের অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। ১৯৬৭ সালের পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিনের বিবৃতি ছিলো “পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিরোধী রবীন্দ্র সংগীত প্রচারিত হবেনা”। ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন এবং মানুষের তৈরী
করা শত্রুতার পাশবিক নিষ্ঠুরতা ও ভয়ানক পরিনতি ১১ বছর বয়সী নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেনের চোখেও দৃশ্যমান। ১৯৪০ সালের হিন্দু-মুসলিম দাংগার বিভৎসতা এবং এ হামলার শিকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী তার বিবরণ তিনি হোম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ডঃ আ মেয়ার নামক স্মৃতি কথা মূলক তার বইতে বিস্তারিত তুলে ধরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন “সাম্প্রদায়িক হামলার মূল বিষয়টি হচ্ছে ক্ষমতা, যার ক্ষমতা আছে সে ক্ষমতা বঞ্চিতদের হামলা করবে এটাই হয়ে দাড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সত্য” । (প্রথম আলো ৩১ অক্টোবর ২০২১)। এক কথায় দূর্বলের উপর সবলের অত্যাচার। দূর্বল হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

মামা,

অতীতের সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সকল ঘটনা বিচারিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অবৈধ দখলকারী থেকে হিন্দুসম্পত্তি উদ্ধারে পদক্ষেপ নিতে হবে। সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও বৈষম্য বিলোপ আইন এমন কি জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবীর বিষয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষণ করে সরকারকে তড়িৎ গতিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশের কারণে সুন্দর বনের বাঘ যেমন দিন দিন বিলীন হতে চলেছে তেমনি এদেশের সংখ্যালঘুরা দিনের দিন ভারতে পাড়ি দিচ্ছে। এদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দেশভাগের পর সংখ্যালঘুর হার ছিলো জনসংখ্যার ২৯.৭ শতাংশ। সত্তর দশকে তা নেমে ১৯-২০ শতাংশে বর্তমানে ৯.০৭ শতাংশ অর্থাৎ দেড়কোটির মতো হিন্দু এ দেশে বসবাস করে।

এ সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি না করে তাদের নিরাপত্তা সহ সকল সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং বাংগালী সংস্কৃতির জাগরণ ঘটাতে হবে তা না হলে অপশক্তির উত্থান হবে। বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে এবং এদেশ মেধা শূন্য হয়ে পড়বে।

মামা,

পাশে সরিষাদি রেলস্টেশন, স্কুলে হোস্টেলে থাকা বিনোদন মুখী ছাত্রগন রেলযোগে (বিনাটিকিটে) ফেনীতে গিয়ে সিনেমা দেখে আসত। কিন্তু প্রধান শিক্ষক শামসুল হুদা চৌধুরীর হাতে ধরা পড়লে স্কুল মাঠের খুটির সাথে বেধে চরম বেত্রাঘাত। এ দৃশ্য দেখে আমার সিনেমা দেখার সাধ অংকুরে বিনষ্ট। কলেজ পরীক্ষার শেষ দিনে ফেনীর ট্রাংক রোডের সুরত সিনেমা হলে কবরী অভিনীত ;বধু বিধায় ; ছবি দেখার প্রথম অভিষেক। আরো জানার সুযোগ হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরীর সাথে ঘনিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে। তবে বিটিভির;”কথা
মালা;” অনুষ্ঠানে সিনেমা বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো। কবি সাহিত্যেক অভিনেতা অভিনেত্রীদের জীবন জীবিকা হাল-চাল সাধারন থেকে অনেক ভিন্নতর যা সমাজের সবমহল অবহিত। এ বিষয়ে আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক হলেও আমার লেখার বিষয় বস্তুর কারণে প্রাসঙ্গিক। এদের আলোচনা -সসমালোচনা সকলে কান পেতে শোনে কেউ আনন্দ পায় কেউ কষ্ট পায়।
প্রখ্যাত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী মিনুকে ফেলে সকলের প্রিয় মুখ, সেরা অভিনেত্রী বর্তমান সাংসদ ও একুশে পদক প্রাপ্ত সুবর্ণা মোস্তফাকে বিয়ে করেন। আবার সুবর্ণা মোস্তফা অল্প বয়সের সৌদকে বিয়ে করে নতুন সংসার, শুরু করেন। নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ গুলতেকিন কে ছেড়ে মেয়ের বান্ধবী শাওনকে বিয়ে করে ভক্তকুলের কাউকে আনন্দ আবার কাউকে কষ্ট দেন। শামসুদ্দিন আবুল কালামের মতো কথা সাহিত্যেককে ছেড়ে হোসনে আরা গোলাম মোস্তফার ঘরে চলে যায়। ৯০ দশকের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সার কোন লুকোচুরি না করে কিশোরগঞ্জের অধিক বয়সী রেজা আমিন সুমন কে তৃতীয় বিয়ে করে সামাজিক যোগাযোগে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তোলেন। তারকাদের সমালোচনা থাকা স্বাভাবিকতা হয়ে দাড়িয়েছে।

মুম্বাইয়ের ব্যবসায়ী ও কবি রবি শর্মাকে ২য় বিয়ে করে শাকিলা জাফর, শাকিলা শর্মা বদলে যান, হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হন। ব্যতিক্রম থাকবেই, যেমন বিল গেটসের ২৭ বছরের সংসার এক পলকে ভেংগে গেল। বিনা কারণে রোমিও ও জুলিয়েটের অকাল মৃত্যু হয়েছিল। জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহের মৃত্যু রহস্য এখনও অনাবিষ্কৃত। ঐদিন দেখলাম উঠতি বয়সের নায়িকা পরিমনি,তাকে নিয়ে আলোচনা আর সমালোচনার ঝড়। ন্যাক্কারজনকভাবে ব্যাক্তিজীবনের মুখরোচক ঘটনা নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিড়িয়ার প্রকাশ ও প্রচার যা মোটেই শোভনীয় ছিলনা। পরিবার পরিজন নিয়ে এগুলো দেখা রীতিমতো অস্বস্তিকর। শামসুন্নাহার স্মৃতি থেকে পরিমনি। ভক্তদের ডানাকাটা পরিমনি। রুপগুণের কমতি নেই, বুদ্ধি মত্তার অভাব নেই, আবেগের শেষ নেই। যার ফলে রাতারাতি নায়িকা খ্যাতি পেয়ে যায়। মা-বাবা ছাড়া খালা-নানার বাড়িতে বেড়ে উঠা এ নায়িকা প্রথমে মডেল তারপর নাটকে এবং রুপালী পর্দায় জায়গা করে নেয়। এরই মাঝে ৪ টি বিবাহ এবং ৩২ টি ছবিতে
অভিনয় করার যোগ্যতা অর্জন করে। দৃষ্টিনন্দন অভিনয় করে কিশোর কিশোরীসহ প্রযোজক পরিচালকদের দৃষ্টি কেড়ে নেন। মেধাবী ছাত্রী হলেও লোভের কারণে লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ে, তবে রুপের বদৌলতে কোটি কোটি টাকার মালিক আলিশান বাড়িতে বসবাস আর দামী গাড়ির মালিক বনে যায়। গত ৪ আগস্ট শত শত র‍্যাব পুলিশের উপস্থিতিতে মামলা ছাড়া বনানীর বাসা থেকে গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তারের আগে পরিমনির লাইভশোতে আসার বিষয়টি সরকারের সাজানো নাটক এবং সমসাময়িক বিষয়কে আড়াল করার জন্য সরকারের কৌশল বলে রাজনীতিবিদেরা মন্তব্য করেন। কিন্তু মধ্যরাতে ঢাকা বোট ক্লাবে তার মারদাঙ্গা উপস্থিতিতে সরকারের সাজানো নাটক হতে পারে না। তার বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। ৩ দফায় ৭ দিন রিমান্ড মনজুর করায় শিল্পী সমিতি, প্রযোজক সমিতিসহ সংশ্লিষ্টরা তেমন মুখ না খুললেও মানবাধিকার কর্মীরা একজন শিল্পীর ওপর অমানবিক আচরণ এবং অযথা হেনস্থার প্রতিবাদে সকলেই এগিয়ে আসে। প্রখ্যাত সাংবাদিক গাফফার চৌধুরী প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানান এবং সকল সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড. আই খান পান্না(আইন সালিশ কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি) পরিমনির মামলা হাতে নেন। মামলার ৩ দফার প্রথমে ৪ দিন , দ্বিতীয় দফায় ২ দিন, তৃতীয় দফার ১ দিন রিমান্ড দেয়ার প্রেক্ষাপটে স্বপ্রনোদিত রুল চেয়ে এ বেঞ্চে আবেদন করে ছিলো আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক)। নিম্ন আদালতের দুই বিচারক আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা চাইতে হয়েছে। জামিনে মুক্তি পেয়ে মাথায় সাদা কাপড় পরে “ডোন্ট লাভ মি বিচ” লেখা প্রদর্শন করে নান্দনিক কায়দায় কাশিমপুর কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন এবং ভক্তদের দৃষ্টি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।তবে জন্মদিনে তার লুংগি ড্যান্স অনেকে সহজভাবে মেনে নেননি। এমনকি চলচ্চিত্র অংগনে সমালোচনার ঝড় উঠে। তবে সমালোচনা আর হতাশার মাঝে ও সে ভেংগে পড়েনি, নায়িকা হিসাবে এখানেই তার
স্বার্থকতা।

মামা,

অধিক ভোগবিলাস সঙ্গদোষ, লোভলালসা, উশৃংখল জীবন-যাপন এবং হতাশা এ জগতের লোকদের বিপদগামী করে তোলে ফলে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং সামাজিকতার বন্ধন তাদের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এত খ্যাতি আর সুনাম অর্জনের পরও নন্দিত অভিনেত্রী কবরী সারোয়ার মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে আক্ষেপ করে বলেন আমার একটা দুঃখ রয়ে গেল জীবনে একটা ভালো বন্ধু পেলাম না। ভালো স্বামী পেলাম না,সন্তানেরা যার যার মত করে আছে কিন্তু সঙ্গ দেওয়ার মতো একজন মানুষ পাইনি,যাকে বলতে পারি এসো এক কাপ চা খাই,একটু গল্প করি। অথচ তার অভিনিত প্রথম ছবি “সুতরাং” (১৯৬৪) ১ লাখের বেশী বাজেটের ছবি আয় করেছিলো ১০ লাখ টাকা। ফ্রাংকফুট চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি পেয়ে ছিল দ্বিতীয় সেরা পুরস্কার। বিলেতের রাজা-রাণী সে ছবিতে কবরীর অভিনয় (জরিনার ভূমিকায়) দেখে আবেগে আপ্লুত হয়েছিল।

দেবদাস ছবিতে,পার্বতী হিসাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আবহমান বাংলার রমনীর প্রতীক। অথচ এক গুচ্ছ কষ্ট নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

মামা নন্দিত হও নিন্দিত হইও না
যাকে ভালোবাসো,তাকে বেঁচে থাকতে ভালোবাসা দিও
কারণ তাজমহল সারা পৃথিবী দেখলেও
মমতাজ কিন্তু দেখেনি।

ইতি,
তোমারই ভাগিনা।

ইবাংলা /  নাঈম/ ২৯ জানুয়ারি, ২০২২

তাজমহলপত্রালাপ দীর্ঘদিনেরযখন জীবিত থাকে
Comments (0)
Add Comment