রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছয়টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার সুবিধা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণখেলাপি কমাতে পারছে না। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও কঠোর হতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ১৭৮ কোটি টাকা। এ সময়ে সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ মোট ঋণের ২০ শতাংশের বেশি। এর বাইরে আছে অবলোপন করা আরও সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।
নানা সময় আলোচনা-সমালোচনার পর টাকা উদ্ধারে ব্যাংকগুলো প্রায়ই আদায় সপ্তাহ বা আদায় মাস ঘোষণা করে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। করোনাকালে যখন নিয়মিত ঋণ পরিশোধেই নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তখন খেলাপি হয়ে যাওয়া অর্থ আদায় আরও কঠিন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মার্চ শেষে সোনালী, জনতা, রূপালী, অগ্রণী, বেসিক ও বিডিবিএল এ ছয় ব্যাংক মোট ২ লাখ ৭ হাজার ৭৭১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এ ঋণের ৪৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকায় অনাদায়ী অর্থাৎ খেলাপি, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ দশমিক ৯১ শতাংশ।
২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ছয় ব্যাংক ২ লাখ ২ হাজার ৩৩০ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ৪২ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। মোট ঋণের ২০ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছিল খেলাপি। মূলধন ঘাটতির শীর্ষেও রয়েছে এসব ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ২৪ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ১১টি। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর ঘাটতিই সবচেয়ে বেশি।
অবলোপন করা ঋণ থেকেও তেমন আদায় করতে পারেনি এসব ব্যাংক। ২০২০ সালে অবলোপনের মাধ্যমে ৬ হাজার ৫৯০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ব্যাংকের ব্যালান্স শিট বা স্থিতিপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো অবলোপন করে ১ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা বা মোটের ২০ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন বলেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় কমেছে মাত্র ১২ কোটি ৭৪ লাখ টাকার মতো, যা শতকরা হিসেবে দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আর্থিক কেলেঙ্কারি, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ হচ্ছে। এই বিশাল অর্থ উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।’
সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকারি ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে। ঋণের গুণগত মান, খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি, পরিচালকদের বেপরোয়া ঋণ গ্রহণ এসব সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। এসব ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রম বাড়ানো প্রয়োজন। তবে শুধু তদারকি বাড়ালে হবে না, অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংকার, গ্রাহক ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের উচিত রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়ানো ও খেলাপি ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করা। একই সঙ্গে যারা ব্যর্থ হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।’
জনতা : রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে খেলাপি ঋণে শীর্ষ অবস্থানে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। মার্চ শেষে ব্যাংকটির ৫৭ হাজার ৮২ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি ১৩ হাজার ৫৭০ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ২৩.৭৭ শতাংশ। সেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১২ হাজার ৮৮৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। তিন মাসে ব্যাংকটির আরও ৬৮৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে। মার্চে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ৪১৭ কোটি টাকা, যা তিন মাস আগে ছিল ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা।
সোনালী : সবচেয়ে বেশি আমানতের এই ব্যাংকটি মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকটির ঘাটতি ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ডিসেম্বর শেষে ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। তবে খেলাপি ঋণের দিক দিয়ে কিছুটা উন্নতি করতে পেরেছে ব্যাংকটি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যাংকটি খেলাপি ঋণ থেকে আদায় করেছে ৩২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
বর্তমানে ব্যাংকটির খেলাপি ১০ হাজার ৬৮৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ১০ হাজার ৭২১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মার্চ শেষে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ৫৩ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।
অগ্রণী : রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের অনিয়ম কম নয়। ঋণ খেলাপিও বেড়েছে তাদের। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৫ হাজার ৫৫৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তিন মাসে খেলাপি বেড়েছে ১ হাজার ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ অগ্রণী ব্যাংক। মার্চ শেষে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ২ হাজার ৯২১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী এ ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৯০৩ কোটি টাকা। মার্চ শেষে অগ্রণীর ঋণ বিতরণ ৪৭ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৬ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ১৩ দশমিক ৭১ শতাংশ।
রূপালী ব্যাংক : সরকারের রূপালী ব্যাংকটিতে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৭৬১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। মোট ঋণের পরিমাণ ৩২ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। মার্চ শেষে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৮৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ১১ দশমিক ৯৯ শতাংশ। তবে ডিসেম্বরের চেয়ে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তখন ব্যাংকটিকে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ হাজার ৯৭২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। ওই সময় বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৭০ শতাংশ ছিল খেলাপি। ৩ মাসে আদায় ৮৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
বেসিক : সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে শতকরা হিসেবে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে বিশেষায়িত বেসিক ব্যাংক লিমিটেড। মার্চ শেষে এদের ঋণ বিতরণ ১৪ হাজার ৬০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৮ হাজার ৮০ কোটি ৭২ লাখ, যা বিতরণকৃত ঋণের ৫৫.৩৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৫০২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। তিন মাসে ব্যাংকটির ৫১৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৭২ কোটি টাকা। তবে এই দিক থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আগের প্রান্তিকের চেয়ে এটি ২৮ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের বড় অংশ এখনও আদায় করা সম্ভব হয়নি। এর প্রায় ৯০ শতাংশই আদায়যোগ্য নয়। এ সময়ের মধ্যে ব্যাংকটি থেকে অন্তত ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
বিডিবিএল : সরকারের বিশষায়িত ব্যাংক এটি। তিন মাসে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬৩ কোটি ৮ লাখ টাকা। ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯৫ কোটি ৬ লাখ টাকা। মার্চ শেষে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ ১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৬৫৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা। যা বিতরণকৃত ঋণের ৩৫.৩৬ শতাংশ। বিডিবিএলের কাছে জমা আছে গ্রাহকের ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার আমানত।
ই-বাংলা/ আইএফ/ ১৫ জুলাই, ২০২১