বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান মাঠে ও মাঠের বাইরে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন সময়ে আলোচিত ও পরিচিত। সাকিব শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘পোস্টার বয়’ না দেশের করপোরেট জগতেও একজ বড় ব্যবসায়ী বটে।
পণ্যদূত হিসেবেও রয়েছে তার বেশ পরিচিতি। এছাড়াও নানামুখী বিনিয়োগ ও ব্যবসার মাধ্যমে করপোরেট জগতে এরই মধ্যে নিজের পরিসর বড় করে এগিয়েছেন ক্রিকেটের সাকিব।
যদিও রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবসায়ী হিসেবে হাতেখড়ি সাকিব আল হাসানের।
এরপর দ্রুতই নিজের ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল বিস্তৃত করেছেন তিনি। দেশের শেয়ারবাজার, বিদ্যুৎকেন্দ্র, প্রসাধনী, ট্রাভেল এজেন্সি, হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়া ও কুঁচের খামারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে তার। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে বড় অংকের বিনিয়োগ করেছেন সাকিব আল হাসান।
তবে গুনঞ্জন আছে, সবকিছুকে ছাড়িয়ে সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারের বড় প্রভাবক হয়ে উঠেছেন সাকিব। বড় অংকের অর্থ লগ্নি করেছেন তিনি। পুঁজিবাজারের বড় ‘প্লেয়ার’দের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছে তার।
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শুভেচ্ছাদূত সাকিব আল হাসান সম্প্রতি একটি ব্রোকারেজ হাউজের অনুমোদনও পেয়েছেন। সব মিলিয়ে ক্রিকেটের মাঠ ছাপিয়ে করপোরেট জগতের বড় উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন সাকিব আল হাসান।
দীর্ঘ অনুসন্ধানে ব্যাংক হিসাবের তথ্য পর্যালোচনার পাশাপাশি তার ব্যবসায়িক সহযোগী ও সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সাল-পরবর্তী সময়ে ব্যবসায় জগতে পা রাখেন সাকিব আল হাসান। বিভিন্ন খাতে একের পর এক বিনিয়োগ করেছেন তিনি।
কিন্তু ব্যাট-বল হাতে সাকিবের যে সাফল্য তা ধরা দেয়নি ব্যবসায়। দেশে তার বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই রুগ্ণ। কিছু প্রতিষ্ঠান তিনি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি দেশে ব্যবসায়িক কার্যক্রম সীমিত করে সাকিব আল হাসান যুক্তরাষ্ট্রমুখী হচ্ছেন।
কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের শিকলবাহায় ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার ডুয়াল-ফুয়েলভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে আবেদন করে সাকিব আল হাসানের কনসোর্টিয়াম।
এনইএল-আরএমএল-এসএনইপিএসসিএল এনার্জি কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রস্তাব দেয় বিপিডিবির কাছে। চুক্তি স্বাক্ষরের দেড় বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসার কথা জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অনুমোদিত প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো চিঠিতে সাকিব আল হাসান নিজেই সই করেন। চিঠিতে কনসোর্টিয়ামটির প্রধান কার্যালয় দেখানো হয় রাজধানীর প্রগতি সরণির রূপায়ণ মিলেনিয়াম স্কয়ার। যদিও আবেদনপত্রটি অসম্পূর্ণ হওয়ায় বিপিডিবি সেটি ফেরত দেয়।
এরপর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যৌথভাবে করার জন্য দেশের একাধিক বড় শিল্পোদ্যোক্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। তবে এটি এখনো বিপিডিবিতে আবেদিত অবস্থায় রয়েছে।
রাজধানীর বনানীতে সাকিব’স ডাইনস নামে একটি রেস্টুরেন্ট করেন সাকিব আল হাসান। ২০১৫ সালে রেস্টুরেন্টটির উদ্বোধন করা হয়। যদিও কিছুদিন পরই রেস্টুরেন্টটি বিক্রি করে দেন তিনি। বর্তমানে রাজধানীর মিরপুর ও ধানমন্ডিতে ‘সাকিব’স-৭৫’ নামে দুটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
২০১৬ সালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালীতে ১৪ একর জমির ওপর কাঁকড়া ও কুঁচের খামার গড়ে তোলেন সাকিব আল হাসান। তবে প্রায় দুই বছর ধরে সাকিব এগ্রো ফার্ম লিমিটেড নামের খামারটি বন্ধ রয়েছে।
বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মণ্ডলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে খামারটি গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু কৃষকদের প্রতিশ্রুত জমির ভাড়া পরিশোধ করা হয়নি।
পাশাপাশি খামারটিতে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বকেয়া পড়ায় গত বছর শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেছিলেন। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাকিব এগ্রো ফার্ম লিমিটেড বন্ধ রয়েছে।
স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরের আগ্রহে প্রসাধনী ব্যবসায়ও নেমেছিলেন সাকিব আল হাসান। রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে কসমিক জোভিয়ান নামে একটি কসমেটিকস শপ উদ্বোধন করেন সাকিব।
যদিও কাঁকড়ার খামারের মতোই বন্ধ রয়েছে বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডের কসমেটিকস বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল শপিং মলটিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কসমিক জোভিয়ানের শোরুমটি বন্ধ রয়েছে অনেক দিন ধরেই।
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ফিয়েস্তা নামে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সাকিব আল হাসান। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা হলেও সাকিব সেটির সঙ্গে যুক্ত হন ২০১৫ সালে।
প্রতিষ্ঠানটির ১৩ জন পরিচালকের মধ্যে সাকিব আল হাসান চেয়ারম্যান ও নকীব চৌধুরী ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অবশ্য সাকিবের এ ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির বিরুদ্ধে জাপানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আড়ালে মানব পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৮ সাল-পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার সৌদি আরব সফরে যান সাকিব আল হাসান। সাকিবের সহপাঠীরা বলছেন, ওমরাহ করার কথা বলে সৌদি গেলেও এক্ষেত্রে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসা সম্প্রসারণ। ওই সময় সাকিব সৌদি আরবে একাধিক আবাসিক হোটেল কেনেন।
বাদ যায়নি ট্রাভেলস ব্যবসা। ২০২০ সালে ‘সাহ-৭৫ টুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস ম্যানেজমেন্ট’ নামে একটি ট্রাভেলস এজেন্সি উদ্বোধন করেন সাকিব। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসাও বন্ধ।
এর দুই বছর আগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারের হোয়াইট স্যান্ড রিসোর্ট হোটেল কাম শপিং মলে ২০ হাজার বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেস কেনারও চুক্তি করেন সাকিব।
২০১৭ সাল থেকে বিএসইসির শুভেচ্ছাদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন সাকিব আল হাসান।
চলতি বছরের মে মাসে সংস্থাটির কাছ থেকে প্রাথমিক অনুমোদন পেয়েছে তার মালিকানাধীন মোনার্ক হোল্ডিংস। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেয়া নথিতে দেখা যায়, মোনার্ক হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান পদে নাম রয়েছে ক্রিকেট অল রাউন্ডার সাকিব আল হাসানের।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন পুঁজিবাজারে বহুল আলোচিত শেয়ার ব্যবসায়ী ও সমবায় অধিদফতরের কর্মকর্তা আবুল খায়ের হীরুর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান। আর পরিচালক হিসেবে জাভেদ এ মতিন ও আবুল কালাম মাতবরের নাম দেখা গেছে।
২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলছেন সাকিব আল হাসান। ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট, বিগ ব্যাশ, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, শ্রীলংকান প্রিমিয়ার লিগ, পাকিস্তান সুপার লিগসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই খেলছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশী বিভিন্ন লিগে খেলে বিপুল পরিমাণ আয় করেছেন সাকিব আল হাসান। কিন্তু বিদেশে খেলে উপার্জিত অর্থ তিনি দেশে আনেননি। উপার্জিত অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গিয়েছেন সাকিব। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ রয়েছে তার। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন স্টেটে বাড়ি কিনেছেন সাকিব আল হাসান।
২০০৯ সাল-পরবর্তী সময় থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছাদূত ও পণ্যদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হতে থাকেন সাকিব আল হাসান। ওই সময় ১৫ লাখ টাকায় শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন একটি ব্যাংকের সঙ্গে। সে চুক্তির মাধ্যমেই দেশের ব্যাংক খাতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে সাকিব আল হাসানের।
তার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে ব্র্যাক ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডসহ বিভিন্ন ব্যাংকের শুভেচ্ছাদূত হয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে পেপসি, বাংলালিংক, ক্যাস্ট্রল, লাইফবয়, সিঙ্গার ইলেকট্রনিকস, নরটন অ্যান্টিভাইরাস, বুস্ট, লা রিভ, লেনোভো, রানার মোটরসাইকেল, জা’এনজি আইসক্রিম, টিফিন বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনী দূত হিসেবে কাজ করেছেন সাকিব ।
সাকিব আল হাসানের প্রধান ব্যাংক হিসাব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে। এছাড়া ইউসিবি, ইবিএল, ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকে তার হিসাব রয়েছে। সাকিবের দীর্ঘকালীন সহপাঠী, ব্যাংকার, পুঁজিবাজারের বিও অ্যাকাউন্টসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তার সম্পদের পরিমাপ করার চেষ্টা করেছে দৈনিক প্রতিনিধির অনুসন্ধানী টিম।
তবে তারকাদের আয় ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করে এমন বেশকিছু ওয়েবসাইট থেকে সাকিব আল হাসানের মোট সম্পদের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়। ক্রিকট্রেকারের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে সাকিব আল হাসানের সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৩ কোটি ডলার।
আর ক্লাউডনেটওর্থের হিসাবে ২০১৯ সাল শেষে সাকিবের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অন্যদিকে নেটওর্থআইডিয়ার মতে, ২০২১ সালে সাকিবের সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ৪ কোটি ডলার, বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) চুক্তিবদ্ধ খেলোয়াড় হিসেবে পাওয়া বেতন, ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ থেকে আয়, পণ্যের দূত হিসেবে আয়সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসা থেকে আয়ের ভিত্তিতে সাকিব আল হাসানের মোট সম্পদের পরিমাণ হিসাব করেছে ওয়েবসাইটগুলো।
তবে নিজের ব্যবসা ও সম্পদ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি সাকিব আল হাসান। শনিবার (১২ জুন) প্রতিনিধির পক্ষ থেকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কোনো বিষয়েই এ মুহূর্তে আমি কথা বলতে চাই না।’<<
ই বাংলা/ আইএইচ/ ১৩ জুন, ২০২১