বরগুনা সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অমর চন্দ্রের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে যৌন হয়রাণী ও অনৈতিক সুবিধা আদায়ে কলেজ অধ্যক্ষের নিকট বিচার চেয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
এক শিক্ষার্থীর অভিযোগ, বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অমর চন্দ্রের হাতে ইনকোর্স ও মৌখিক পরীক্ষার নম্বর থাকায় তিনি শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য করা, শ্রেণিক্ষ ও প্রাইভেটে ছাত্রীদেও যৌন হয়রাণি এবং ছাত্রদের দিয়ে বাজার সওদাও করিয়ে খাচ্ছেন।
বুধবার ওই কলেজের বাংলা বিভাগের চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্র এনামুল হক শিক্ষক অমর চন্দ্রের বিরুদ্ধে অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন অধ্যক্ষ।
অধ্যক্ষের কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগে এনামুল হক উল্লেখ করেছেন, বাংলা বিভাগের শিক্ষক অমর দাসের কাছে আমরা গোটা ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীর এক প্রকার জিম্মিদশায় আছি।
তার হাতে থাকা ভাইবা ও ইনকোর্সের মার্কসের সুবিধা নিয়ে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে নানা প্রকার অনৈতিক আবদার করেন। বিশেষ করে ভাইবায় মার্কস দেয়ার জন্য তিনি অর্থ দাবি করেন। গরীব অসহায় শিক্ষার্থীরা কেউ টাকা না দিলে তাদেরকে সর্বনিম্ম মার্কস দেয়ার ভীতী প্রদর্শন করেণ। একইভাবে ফুল মার্কস দেয়ার বিনিময়ে তিনি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বাজার সওদা করানো, পোশাকাদি কিনে দেয়ার আবদার করছেন।
এনামুল বলেন, স্যার আমাদের বিভিন্ন সময়ে তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে থাকেন। ভাইবার ও ইকোর্র্স মার্কসের দোহাই দিয়ে আমার কাছ থেকেও অমর স্যার একাধিকবার ইলিশ মাছ, কৈ মাছ, দেশী মুরগীসহ বাজার সওদা করিয়ে খেয়েছেন।
এছাড়াও তিনি কলেজের ভেতরে যে কক্ষটিতে থাকেন, ওই কক্ষের খাট ভেঙে যাওয়ায় গভীর রাতে ডেকে নিয়ে খাট মেরামত পর্যন্ত করিয়েছেন। একইভাবে তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে প্রায় সব ছাত্রদের ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, বাজার সওদা করে খাওয়ানোসহ নানা কাজে বাধ্য করছেন।
গণমাধ্যমের হাতে আসা একটি ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, শিক্ষক অমরচন্দ্র কলেজের বিপরিতে একটি বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর সময় এক ছাত্রীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়ার চেষ্টা করছেন। এ অবস্থায় ওই শিক্ষার্থী বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে পেছনের দিকে বসেন।
এছড়াও ক্লাস চলাকালীন একজন ছাত্রীর শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করছেন শিক্ষক অমর চন্দ্র। একইভাবে একজন ছাত্রী স্যারের এমন আচরণের বিষয়ে সহপাঠির সাথে কথোপথনেরও একটি কল রেকর্ড, একজন ছাত্রকে মাছ ও খাসির মাংস কিনে নিয়ে আসার কয়েকটি কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সরবরাহ করেছেন শিক্ষার্থীরা।
ভিডিও দেখানোর পর ওই কলেজেরই বাংলা বিভাগের সরকারি অধ্যাপক শীরিন সুলতানা নিশ্চিত করেন ওই ভিডিওর ব্যক্তিটি বিভাগীয় প্রধান অমর চন্দ্রের।
শিরীন সুলতানা বলেন, আমার কাছেও স্যারের এমন আপত্তিকর আচরণের বিষয়ে শিক্ষার্থীদেও কাছ থেকে অভিযোগ এসেছিল। কিন্ত ছাত্রীদেও ডেকে জিজ্ঞেস করলে তারা অস্বীকার করেছিল।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বাংলা বিভাগের চুড়ান্ত বর্ষেও এক ছাত্রী জানান, তিন চারমাস আগে বৃষ্টির মধ্যে একদিন প্রাইভেট পড়তে গিয়েছিলেন তিনি। এসময় পেছনের বেঞ্চে বসায় স্যার তাকে ডেকে সামনে সাড়িতে নিয়ে বসিয়ে শরীর স্পর্শ করে আপত্তিকর আচরণ শুরু করেন। ক্ষোভে ঘৃণায় তিনি চলে আসেন এবং তারপর থেকে আর প্রাইভেট পড়তে যাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা বিভাগের বেশ কিছু শিক্ষার্থী জানান, অমর স্যার শিক্ষার্থীদেরকে মার্কসে জিম্মি করে প্রাইভেট পড়ানোয় বাধ্য করেন। তিনি কলেজে যোগদানের পর থেকে এভাবেই বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসছেন। স্যারের হাতে মার্কস জিম্মিদশার কারণে কেউ কিছু মুখ খুলে বলছেনা। তার বিরুদ্ধে মুখ খুললে সর্বনিম্ন মার্কস দেয়া এমনকি ফেল করানোর পর্যন্ত হুমকি দিয়ে থাকেন।
কয়েকজন ছাত্রী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মুঠোফোনে জানান, শিক্ষক অমর চন্দ্র ইনকোর্স ও ভাইভায় ফুল মার্কস দেয়ার বিনিময়ে তাকে ‘বিশেষ সময়’ দেয়ার প্রস্তাব পর্যন্ত দিয়েছেন। এছাড়া প্রাইভেট পড়ানোর সময় তিনি একাধিক ছাত্রীকে শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়ার মত যৌন হয়রাণি করে আসছেন। ছাত্রীরা লজ্জা ও মার্কস না পাওয়ার ভয়ে কেউ মুখ খুলছেনা।
একজন ছাত্রী জানান, শুধু প্রাইভেটেই না শ্রেণিকক্ষেও তিনি আমাদের সাথে আপত্তিকর আচরণ করেন এবং গায়ে হাত দেন। আমরা খুবই বিব্রতবোধ করি। কিন্ত লজ্জায় কাউকে বলতে পর্যন্ত পারিনা।
অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অমর চন্দ্র বলেন, এসব মিথ্যে অভিযোগ। অনিয়মিত কিছু ছাত্র ভাইভা ও ইনকোর্সে ফুল মার্কস দেয়ার জন্য আমায় চাপ প্রয়োগ করেছিল। কিন্ত ফলাফল অনুসারে আমি মার্কস দেয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যে বিষোদগার করছে। আমি বিষয়টি অধ্যক্ষ স্যারকে জানিয়েছি।
তদন্তকারি কর্মকর্তা বরগুনা সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (ইংরেজি)মোঃ আবদুস সালাম বলেন, এ ঘটনায় অধ্যক্ষ স্যার আমাকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে বরগুনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মতিউর রহমান বলেন, একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে লিখিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। সহযোগী অধ্যাপক মোঃ আবদুস সালাম সাহেবকে প্রধান করে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
ইবাংলা/ টিএইচকে/ ১০ এপ্রিল, ২০২২