উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে বসার যায়গা নেই, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ফাকা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিঃ

ঢাকার বুকে হাজার শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যতম প্রানের বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ছোট্ট ক্যাম্পাসের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে সবার সাথে। ছোট্ট একটি পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হওয়া এই বিদ্যাপিঠ সবার কাছে যেমন জনপ্রিয় তেমনি এর রয়েছে বিশেষ কিছু প্রতিবন্ধকতা।

গত ১৭ মার্চ অনাবাসিক তকমা থেকে মুক্ত হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য স্বাভাবিক যে পরিবেশ থাকার কথা সে পরিবেশ থেকে বঞ্চিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অন্যতম বিশেষ চাহিদা হলো নীরব পরিবেশে লাইব্রেরিতে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে নিজেদের ক্যারিয়ার গুছিয়ে নেওয়া।শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা ইবাংলা.প্রেসের কাছে তুলে ধরেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নিয়ে নানামুখী সংকটের কথা।

নতুন ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় একটি অংশে অবস্থিত লাইব্রেরিটি সপ্তাহে ৫ দিন ররিবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮ থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য খোলা থাকলেও নানা জটিলতার কারনে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিবিমুখ শিক্ষার্থীরা।
ক্যাম্পাসের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় লিফট তাই অনেকেই ষষ্ঠ তলার উপরে সিড়ি বেয়ে উঠতে অপরাগ বোধ করেন আর সেখানকার নানান সমস্যা তো আছেই।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি থাকলেও অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থী ছাড়া কেউ ই যায়না সেখানে। সেখানে না যাওয়ার পিছনে রয়েছে বিস্তার অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ঘুরে সরেজমিনে দেখা যায় ২৮০ জন পাঠক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন লাইব্রেরিতে দেখা মেলেনি ছয় থেকে আটজনের বেশি পাঠক।

পড়াশোনা করতেছে হাতেগোনা কয়েকজন তাও তাদের সাথে নেই কোন বই আছে শুধু খাতা আর কলম। বইয়ের চাহিদা তারা মিটাচ্ছেন মোবাইলের মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বই নিয়ে ঢুকা নিষেধ থাকায় তারা বইয়ের ছবি তুলে অথবা বইয়ের অনলাইন কপি হাতে নিয়ে মোবাইল দিয়ে পড়তে হচ্ছে তাদের।শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে স্বল্পসংখ্যক কিছু বই থাকলেও তা তাদের বর্তমান সিলেবাসের সাথে কোন মিল নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রন্থাগারের নিয়মিত একজন শিক্ষার্থী জানান, আমাদের লাইব্রেরীতে পর্যাপ্ত বই নেই, আমাদের ও বই নিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, এজন্য আমরা অনেক সময় বই কয়েকটি ভাগে কেটে নিয়ে গ্রন্থাগারে প্রবেশ করতে হয়।১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী রোমেল অভিযোগ করে বলেন যে পড়াশোনা করার জন্য লাইব্রেরিতে আসি কিন্তু এখানে ডিপার্টমেন্ট কিংবা চাকুরী সম্পর্কিত বইয়ের দেখা মিলে না তাই আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন বই নিয়ে ঢুকার অনুমতি দেন।

১৩তম ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী সুবির জানায় এখানে পানি পর্যন্ত নাই ২০১৮ সাল থেকে আমি নিয়মিত লাইব্রেরি আসি কিন্তু কোনদিন দেখি নাই শিক্ষার্থীদের জন্য পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে এছাড়া বইয়ের সমস্যা তো আছেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান লাইব্রেরীতে বইয়ের সমস্যার পাশাপাশি আমরা যখন ঢোকার জন্য টোকেন নিতে যাই বেশিরভাগ সময় কয়েকবার বলার পরেও তারা কর্নপাত করেন না। আমি টোকেন চাচ্ছিলাম দায়িত্বরত উনি পেপার পড়ায় ব্যস্ত প্রায় ৩/৪মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে টোকেন নিয়ে ঢুকতে হয়, ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরো জানান এভাবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি চলতে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে কেউ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে আসবেই না।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের মোট পুস্তক সংখ্যা ৩১ হাজার ৬০০। সুনামধন্য ৮টি পাবলিশার্স এর প্রকাশনায় ই-বুকস এর সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০। ই-জার্নালের সংখ্যা ৪৪ হাজার ১০০। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য ই-লাইব্রেরি সেবা চালু হয় ২০১৫ সালের ৩ মার্চ।

এখানে ই-লাইব্রেরির জন্য ল্যাপটপ আছে ১০৩টি। গবেষণা কাজের জন্য প্রিজার্ভ পত্রিকা রয়েছে ৯টি। এখানে রেফারেন্স বইয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪৮০টি, পিরিউডিক্যাল বই ২ হাজার ৪০৫টি। রেফারেন্স শাখায় জার্নাল রয়েছে ১ হাজার ১০১টি আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ১ হাজার ৬৭২টি।

নিয়মিত উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করা সমাজবিজ্ঞান বিভাগ দশম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান জানান কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ফাকা থাকার পিছনে প্রশাসনের উদাসীনতাই দায়ী আমরা সকাল ৭টা থেকে রাত ১০ট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পড়ার সুযোগ চাই। তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরো সাফল্য আশা করা যেত। একরকম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন আমি প্রথম কিছুদিন সেখানে গিয়েছিলাম সেখানে যেতে হলে কার্ড করা লাগে কার্ড করতে হলে নানান ঝামেলা পোহাতে হয় সেখান থেকেই ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে শিক্ষার্থীরা।আর লাইব্রেরিতে যারা দায়িত্বরত আছেন তারা যেন প্রবল শক্তিশালী সেখানে কিছুই বলা যায় না।

উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে বসা আরেক শিক্ষার্থী নুরুল ইসলাম খান বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ফাকা কেন থাকে তা নিয়ে বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে প্রশাসনের উদাসীনতার জন্য শিক্ষার্থীরা সহজে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ব্যবহার করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এছাড়া কিছু রাজনৈতিক কারনও থাকতে পারে বলে আমার মনে হয়।

আমরা যারা উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে বসে পড়ি হঠাৎ করেই তাদের উঠিয়ে দেওয়া হয় কারন ছোট ভাইদের ক্লাস থাকে তখন দেখা যায় আমরা পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে পড়তে বসতে পারি না আমাদের মাথায় রাখতে হয় যেকোন সময় ক্লাসের জন্য আমদের উঠে যেতে হবে।১২তম ব্যাচে অধ্যয়নরত আমান উল্লাহ আমান জানান আমাদের যায়গা সংকটের কারনে আমরা বসার যায়গা পাই না অথচ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি খালি পড়ে থাকে এখন বৃষ্টির মৌসুম যেকোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে আমরা রুমের ভিতরে যারা যায়গা পাচ্ছি না তারা কলা ভবনের বারান্দায় বসে পড়তে হচ্ছে বৃষ্টি হলে আমাদের বসার মত যায়গা থাকে না।

তিনি বলেন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডিং রুম থাকে, লাইব্রেরি থাকে আমাদের তো কিছুই নাই, যা আছে একটা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি তাও সেখানে আমরা চাকুরীর কোনো বই নিয়ে যেতে পারি না তাই এক প্রকার জেদ করেই অধিকাংশ শিক্ষার্থী লাইব্রেরিমুখী হচ্ছে না। এতে ক্ষতি যেমন আমাদের হচ্ছে তেমনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কম ক্ষতি হচ্ছে না। আমরা যদি বেশি না ২টা স্থায়ী বড় রিডিং রুম পাই তাহলেও আমরা চাকুরীর বাজারে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবো।

তিনি আরো অভিযোগ করে বলেন,আমরা যারাই এখন এখানে পড়তে বসি তারা দুপুরে খাওয়ার জন্য আমাদের একমাত্র ক্যান্টিনে যাই সেখানেও খাবারের যে মান তা সত্যি সন্তোষজনক নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার(ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য) অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদের কাছে মুঠোফোনে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির অব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত আসতেছে উপাচার্য মহোদয় দেশে ফিরলে শিক্ষার্থী বান্ধব এক সিদ্ধান্ত নিব।যারা এখন উন্মুক্ত লাইব্রেরিতে কষ্ট করে পড়াশোনা করছে তারা এর সুফল পাবে।

তিনি আরো বলেন যারা পাশ করে বের হয়ে গেছেন তারা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ব্যবহারের সুবিধা পাবেন না বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নিয়ে সিদ্ধান্ত আসছে।

লাইব্রেরী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কর্মচারীদের রূঢ় ব্যবহারের ব্যাপারে তিনি জানান, লাইব্রেরীর সংশ্লিষ্ট কেউ যদি কোন শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকে আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ জানানো হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।
অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর প্রধান কাজ হওয়া উচিত কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিমুখী হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণ সুযোগ দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচিত বর্তমান সিলেবাসের অনুসরণ করে যথেষ্ট পরিমাণ বই সংযোজন করা যাতে শিক্ষার্থীরা এখন থেকেই নিজেদেরকে গড়ে তোলার সুযোগ পায়।

কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ইবরাহীম ফরাজী ও সাধারণ সম্পাদক এস এম আকতার হোসাইন বলেন, আমরা ভিসি স্যারের সাথে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি নিয়ে কথা বলেছি স্যার বিদেশ থেকে দেশে ফিরলেই কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

ইবাংলা / জেএন / ১৭ মে, ২০২২

কেন্দ্রীয়ফাকালাইব্রেরি
Comments (0)
Add Comment