প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন এবং সমর্থন দিয়েছেন বলেই জনগণের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আজ পদ্মা সেতু নির্মাণে সমর্থ হয়েছেন। প্রয়োজনে দেশের উন্নয়নে জীবন দিয়ে হলেও কাজ করে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় ও ব্যক্ত করেন তিনি।
এক সময় দেশের অনেক জ্ঞানী-গুনী ব্যক্তিদের উক্তি- ‘নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়’ এর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজকে নিজেদের টাকায় কীভাবে পদ্মা সেতু করতে পারলাম কারণ, আজকে আপনারা বাংলাদেশের জনগণ আমাকে সমর্থন দিয়েছেন পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর জনগণের শক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি-আমি সেটাতেই বিশ্বাস করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা শনিবার (২৫ জুন) অপরাহ্নে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঠালবাড়ীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় সভাপতির ভাষণে এ সব কথা বলেন।
এক সময় খালেদা জিয়া ও বিএনপি নেতাদের বক্তব্য- ‘আওয়ামী লীগ কোনদিনও পদ্মা সেতু করতে পারবে না’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে খালেদা জিয়াকে বলছি আসুন, দেখে যান পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে কি-না।’ তিনি বলেন, প্রয়োজনে জীবন দিয়ে হলেও দেশের মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাবেন। কারণ, আগামী প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবন নিশ্চিত করাই তাঁর সরকারের একমাত্র লক্ষ্য।
সরকার প্রধান আরও বলেন, ‘আরো উন্নত জীবন যেন আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা পায় তার ব্যবস্থাও আমি করবো। আজকে আপনাদের কাছে এটাই আমার ওয়াদা।’
শেখ হাসিনা বলেন, আজ বাংলাদেশে যেমন আমরা খাদ্য, বিদ্যুৎ ও গৃহহীনদের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। আরো উন্নত জীবন যেন আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা পায় তার ব্যবস্থাও আমি করবো।
তিনি বলেন, ‘বাবা, মা, ভাই সব হারিয়ে পেয়েছি আপনাদের। আপনাদের মাঝেই আমি ফিরে পেয়েছি আমার বাবার স্নেহে, মায়ের স্নেহে, ভাইয়ের স্নেহে, আপনাদের পাশেই আমি আছি, আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আপনাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমি যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সব সময় প্রস্তুত।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশ আপনাদের, এই দেশ আমাদের। জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন এবং এই দেশকে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলা দেশ হিসেবে গড়ে তুলবো।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের সঞ্চালনায় দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী স্বাগত বক্তব্য রাখেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ড. এম আব্দুর রাজ্জাক, সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য- আব্দুর রহমান ও শাহজাহান খান, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন, বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দিন প্রমুখ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কন্যা এবং অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারারপারসন সায়মা ওয়াজেদ।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় আরও বলেন, এই পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ২০০১ সালে তিনি ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করলেও খালেদা জিয়া সরকারের এসে সেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। আবার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে এই পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের সময় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন ড. ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের এমডির পদ থেকে বয়সের কারণে চলে যেতে হল, তখন তিনি আমেরিকায় গিয়ে তদবির করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলেন।
তিনি বলেন, সে সময় বলা হল, দুর্নীতি হয়েছে, কিন্তু কে দুর্নীতি করেছে। যে সেতু আমাদের প্রাণের সেতু, যে সেতুর সঙ্গে আমার এই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য জড়িত। এই সেতু নির্মাণে কেন দুর্নীতি হবে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিশ্বব্যাংক) টাকা দেয়নি কিন্তু দুর্নীতি-ষড়যন্ত্র বলে টাকা বন্ধ করল।
জাতীয় সংসদে তখন তাঁর ঘোষণা- ‘বাংলাদেশ বসে থাকবে না, আমরা নিজের টাকায় এই পদ্মা সেতু তৈরী করবো’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকে অনেক ভাবে বিঘ্ন সৃষ্টির চেষ্টা করেছে এবং তাদের একটা ধারণা ছিল যে বাংলাদেশ নিজের টাকায় এই সে তু নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু, তিনি জনগণের শক্তিতে আস্থা রেখেছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বন্ধের পর তাঁর উদ্যোগে জনগণ ব্যাপকভাবে এগিয়ে আসে এবং তাঁর মাঝেও শক্তি সঞ্চারিত করেছে বলেই আজকে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হয়েছে। তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার কাছেও এজন্য শুকরিয়া জানান।
আর কাউকে এই বর্ষাকালে খরস্রোতা পদ্মা আর পাড়ি দিতে হবে না উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আর কাউকে এই পদ্মা নদী পাড়ি দিতে গিয়ে বাবা, মা, ভাই-বোন, সন্তান বা আপনজনকে হারাতে হবে না, আপনারা সেখানে নির্বিঘ্নে চলতে পারবেন। সেই ব্যবস্থাই আমরা করে দিয়েছি।
তিনি বলেন, আর যারা এই সেতু নির্মাণে বাধার সৃষ্টি করেছিল তাদেরকে এই পদ্মা সেতুর মধ্যদিয়ে উপযুক্ত একটা জবাব আমরা দিতে পেরেছি- আর দেখিয়ে দিয়েছি বাংলাদেশ পারে। আর বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে নাই এবং ভবিষ্যতেও পারবে না।
’৭৫ এর বাবা, মা, ভাইদের হারানোর পর ’৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পর একরকম জোর করেই নির্বাসিত জীবন থেকে তাঁর দেশে ফিরে আসার কথা স্মরণ করে বলেন, নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে ফিরে এসেছিলেন এই বাংলাদেশে, সমগ্র বাংলাদেশ তখন ঘুরে বেড়িয়েছেন।
তিনি সে সময় শরিয়তপুরে আসার স্মৃতিচারণ করে বলেন, লঞ্চে করে আসার পর লঞ্চ নষ্ট হয়ে গেলে নৌকায় করে প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেরিয়েছেন, কাদা-পানিতে নেমেছেন, মিটিং করেছেন, আজকে যে শরিয়তপুরের চেহারা পাল্টে গেছে। কারণ, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে রাস্তা-ঘাট, পুল, ব্রীজ করেছে এবং সার্বিক উন্নয়ন করেছে।
সে সময় মাদারীপুরও সেই লঞ্চে যেতে হোত এবং গোপালগঞ্জ যেতে ঢাকা থেকে ২২ ঘন্টা সময় লাগতো এবং এসব এলাকা অত্যন্ত দুর্গম ছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব এলাকার রাস্তা-ঘাট উন্নয়নসহ তাঁর সরকার শিকারপুর, দোয়ারিকা এবং গাবখান সেতু করে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি করেছে।
তিনি এ সময় করোনাভাইরাস এবং রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি সকলকে টিকা গ্রহণের এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মেনে চলারও পরামর্শ দেন। পাশাপাশি, দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে তা নিশ্চিত করারও আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।
সারাদেশে একশ’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে পদ্মা সেতু হয়েছে এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হবে, কল-কারখানা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসহ নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অন্তত ২১টি জেলার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন আমরা করতে পারবো।
কেননা তাঁর সরকার দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করে যাচ্ছে। যাতে দেশের মানুষের দুঃখ ঘুচে গিয়ে ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে, বলেন তিনি।
তাঁর সরকারের বন্যা মোকাবিলার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সিলেটে বন্যা হচ্ছে সেখানে আমরা ত্রাণ পাঠিয়েছি। এখন বর্ষাকাল এখানেও বন্যা হতে পারে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি আপনারাও প্রস্তুতি নেবেন। কেননা যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার শক্তি বাংলাদেশ এবং এর জনগণ রাখে।
দেশের সকল আর কোন মানুষকে গৃহহীন না রাখায় তাঁর অঙ্গীকার পুণব্যাক্ত করে জাতির পিতার কন্যা বলেন, এমনকি পদ্মা সেতু নির্মাণে যারা জমি দিয়েছেন তাদেরকে সবাইকে জমি ও ঘর প্রদানসহ জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়ার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি এই রৌদ্রজ¦ল দিনে কষ্ট করে জনসভাস্থলে সকলকে আশায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষমান থাকায় শুভেচ্ছা জানিয়ে কবির ভাষায় বলেন- ‘নিস্বঃ আমি রিক্ত আমি দেবার কিছুই নেই/ আছে শুধু ভালবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’ তিনি সকলের সুস্থতা ও মঙ্গল কামনা করে দেশকে যেন এভাবেই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন সেজন্য সকলের নিকট দোয়া চান।
ইবাংলা/টিএইচকে/২৫জুন,২০২২