শ্রমিকদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত ও বিধি বহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ এর অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী ইউনিয়নের দুইজন নেতাকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ। গ্রেফতারকৃতরা হলেন, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক মো. ফিরোজ মাহমুদ হাসান।
মঙ্গলবার (৫ জুলাই ) ভোর সাড়ে চারটায় সেগুনবাগিচা এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করে ডিবি গুলশান বিভাগ। বুধবার (৬ জুলাই ) দুপুরে ডিবি কার্যালয়ে ডিএমপির যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার (সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম ও ডিবি-উত্তর) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) (সদ্য পদায়িত অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, ডিএমপি) উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, গত ৪ জুলাই গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারী এবং টেলিকম ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান মিরপুর মডেল থানায় বিপুল পরিমাণ টাকা প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ এর একটি মামলা করেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিবি-গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান, বিপিএম (বার), পিপিএম কে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি বলেন, মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে ডিবি পুলিশ দেখতে পায়, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে নিয়োজিত শ্রমিক কর্মচারীদের স্থায়ীকরণ না করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ক্রমাগত নবায়ন করে। শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী বাৎসরিক লভ্যাংশের ৫% অর্থ ৮০:১০:১০ অনুপাতে ওয়ার্কাস প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড(WPPF), শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বরাবর প্রদান করার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির “কর্মচারীরা স্থায়ী নয়” এবং “কোম্পানি অলাভজনক” ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার কথা বলে শ্রমিকদের আইনানুগ লভ্যাংশ দেওয়া থেকে বিরত থাকে। বিভিন্ন আইনানুগ দাবি-দাওয়ার কারণে গত ২৫/১০/২০২০ তারিখে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ একযোগে বেআইনিভাবে ৯৯ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করে।
ডিবি কর্মকর্তা বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ ও লভ্যাংশ পাওনা, বেআইনিভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পরে কোম্পানিতে পুনর্বহাল, কোর্টের আদেশ অনুযায়ী পুনর্বহালের পরেও দায়িত্ব¡ না দিলে-কনটেমপ্ট অফ কোর্ট, কোম্পানির অবসায়ন দাবীসহ অন্যান্য দাবীতে শ্রমিকরা এবং শ্রমিক ইউনিয়ন গ্রামীণ টেলিকম এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় শ্রম আদালত এবং হাইকোর্টে প্রায় ১৯০ টি মামলা ও রিট পিটিশন দায়ের করেন। তড়িঘড়ি করে অনেকটা গোপনে এ সকল মামলা উত্তোলন, শ্রমিকদের অর্থ প্রদান এবং প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়।
তিনি বলেন, গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের মধ্যে একটি চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী গত ( ১০ মে) তারিখ ঢাকা ব্যাংক গুলশান শাখায় একটি সেটেলমেন্ট একাউন্ট খোলা হয়। ২০১০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর কোম্পানির মোট লভ্যাংশের ৫% টাকা হারে কোম্পানি হতে এই সেটেলমেন্ট একাউন্টে প্রায় ৪৩৭ কোটি টাকা প্রদান করা হয়। একাউন্টটি হতে অর্থ উত্তোলনের জন্য গ্রামীণ টেলিকমের এমডিকে বাধ্যতামূলক সিগনেটরি এবং ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অন্য দুই সিগনেটরি হিসেবে রাখা হয়।
নিয়মানুযায়ী শ্রমিকদের সকল পাওনাদি উক্ত একাউন্ট থেকেই পরিচালিত হওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী সেটেলমেন্ট একাউন্ট হতে শ্রমিকদের পাওনা এবং ৫% অগ্রিম কর ব্যতীত অন্য কোন অর্থ ছাড় করার সুযোগ না থাকলেও বিধি বর্হিভূতভাবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং উক্ত দুই সিবিএ কর্মচারীসহ ইউনিয়নের কতিপয় নেতার যোগসাজসে উক্ত একাউন্টের অনুমান ৪৩৭ কোটি টাকা হতে চেকের মাধ্যমে গত( ১৭ মে) এবং (২৫ মে) ২৬ কোটি ২২ লক্ষ টাকা গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের ডাচ বাংলা ব্যাংকের একাউন্টে নিয়ে আসা হয়। গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক ইউনিয়নের উক্ত একাউন্টের মোট তিনজন সিগনেটরি ছিলেন গ্রেফতারকৃত সভাপতি, সাঃ সম্পাদক এবং মামলার বাদী অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান।
অন্যান্য শ্রমিকদের ন্যয় টাকা পাওয়ার পরেও যোগসাজশে সিবিএ সভাপতি মো. কামরুজ্জামান, সেক্রেটারি ফিরোজ মাহমুদ হাসান এবং সহ-সভাপতি মাইনুল হাসান ইউনিয়নের একাউন্ট হতে মিরপুরে তাদের ডাচ বাংলা ব্যাংক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের একাউন্টে তিন কোটি করে মোট ৯ কোটি টাকা স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করে। ইউনিয়নের নিয়োজিত আইনজীবী অযৌক্তিক ও অতিরঞ্জিতভাবে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ফি/পারিতোষিক হিসেবে হাতিয়ে নেয়।
তিনি আরো বলেন,প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা আরো জানায়, লভ্যাংশ পাওনা পরিশোধ, অতিরিক্ত অর্থ দেয়ার প্রলোভনের পাশাপাশি গ্রামীণ টেলিকম অফিস ক্যাম্পাসে কর্তৃপক্ষ মেসেজ ছড়িয়ে দেয় যে-বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলংকার মত হবে এবং ক্ষমতার পট পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী হবেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডক্টর ইউনুস; তখন শ্রমিকদের এই সকল মামলা কোন কাজে আসবে না, শ্রমিকরা কোন ক্ষতিপূরণও পাবে না; বিপরীতে তাদের চাকরি হারানো, জেল খাটাসহ অন্যান্য নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে।
মূলত এই ভয়ে এবং কিছুই না পাওয়ার অনিশ্চয়তার বিপরীতে টেলিকম কর্তৃপক্ষের ৪৩৭ কোটি টাকার প্রলোভনে আইনজীবীর পরামর্শে তারা অতি দ্রুততার সাথে বেআইনিভাবে অর্থ তুলে নেয়। টেলিকম ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও আইনজীবী একাধিকবার এই সমঝোতার বিষয়টি গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে বলেন। বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে গ্রেফতারকৃতরা সাত দিনের পুলিশ রিমান্ডে ডিবি হেফাজতে রয়েছে।
ইবাংলা/জেএন/৬ জুলাই,২০২২