ভাগিনার খোলা চিঠি (১২)

এ বি সিদ্দিক

মামা,

মাঠে-ঘাটে বা আড্ডায় এখন কথা কম বলি। লেখাতো দূরের কথা, বলতেও ভয় হয়। কারন আগে মানুষ পাপের
ভয়ে মিথ্যা কথা বলত না। এখন বিপদের কথা ভেবে মানুষ সত্য কথা বলতে চায় না এবং বলেনা। অফিস
আদালতে একই অবস্থা। সর্বত্রই সত্য কথা বলার রেওয়াজ উঠে যাচ্ছে। এমনকি মানুষ প্রতিবাদের
ভাষাও হারিয়ে ফেলছে। ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়ার হাজী ইউনূস আলী স্কুল ও কলেজের শিক্ষক
উৎপল কুমার সরকার কে শিক্ষার্থী আশরাফুল আহসান (জিতু) সব শিক্ষক শিক্ষার্থীর সামনে পিটিয়ে
হত্যা করে। কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পায়নি। নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত
অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জুতার মালা পরিয়ে
লাঞ্চিত করা হয়। কিন্তু ভয়ে কেউ টু-শব্দ করেনি। ঢাকার মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের ৬ জন
শিক্ষক কলেজের দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের রোষানলে
পড়েন এবং বিনা অপরাধে চাকরি হারান। এক যুগেরও বেশী সময়ের তাদের শিক্ষকতা জীবনের অবসান ঘটে
একেবারেই শূণ্য হাতে। ৩১ অক্টোবর ২০২১ থেকে বেকারত্ব জীবনের অভিশাপ নিয়ে তারা এখন মানবেতর
জীবন যাপন করছেন।

গত ৭ জুলাই রাজশাহী রাজবাড়ী ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজার উপর চড়াও হন রাজশাহী ১ আসনের
এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, কিলঘুষি এবং হকিস্টিক দিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট বেধড়ক পিটিয়ে
উক্ত শিক্ষককে গুরুতর জখম করেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও তার চিকিৎসক অভিযোগ সমর্থন
করলেও আক্রান্ত শিক্ষক কোন মামলা করার সাহস পাননি। ( প্রথম আলো, ১৫ জুলাই ২০২২) ৭ জুলাই
এর মাত্র সপ্তাহখানেক আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক আসমা সিদ্দিকা
হেনস্থা হন একজন ছাত্রের কাছে। সাধারন ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে অভিযুক্ত ছাত্রকে সাময়িকভাবে
বহিস্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দেশে রাজনীতি শূণ্যতা আর বিচারহীনতাই এর অন্যতম কারন
বলে অনেকে মনে করেন তবে সামাজিক অবক্ষয়কেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঐক্যন্যাপের সভাপতি পংকজ
ভট্টাচার্যের ভাষায় [ প্রথম আলো, ১৫ মে ২০২২] মানুষের অসহায়ত্ব এখন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে
ভয়াবহ। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা এখন প্রতিনিয়ত বিকৃত ও সংকুচিত হচ্ছে। ইসলামের চতুর্থ খলিফা
হযরত আলী (রাঃ) এর মতে,

কখন বুঝবে একটি দেশ ও
সমাজ নষ্ট হয়ে গেছে,
যখন দেখবে দরিদ্ররা ধৈর্য হারা
হয়ে গেছে,
ধনীরা কৃপণ হয়ে গেছে,
মূর্খরা মঞ্চে বসে আছে,
জ্ঞানীরা পালিয়ে যাচ্ছে
এবং শাসকেরা মিথ্যা কথা বলছে।

তবে মামা, তেলের তেলেশমাতি অবাধে চলছে এবং সুদূর সংসদ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে।
আপনি আমার এমনই একজন, দুটো মা দিয়ে আপনার উচ্চারন। সময় সুযোগে আপনার সাথে মন খুলে কথা
বলি এবং মজা পাই। ছোটবেলা থেকে এ মজা পাচ্ছি যেমন,

আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ী যাই।
ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ।
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।

মামা,
সেদিন বেশী দূরে নয়। স্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে যাবে আমাদের এ নান্দনিক আলোচনা, যৌক্তিক
সমালোচনা ও তাত্ত্বিক পর্যালোচনা।
ভুলে যাবে পাঠক সমাজ খোলা চিঠির ভাগিনার আবেগঘন খোলামেলা কথামালা। যেমনিভাবে ডাকবাক্স আর
পোস্ট কার্ড দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। এ দুটোর ব্যবহার তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রয়োজনীয়তা মোমের
সলতার মত জ্বলছে। বিজ্ঞান দিন দিন উৎকর্ষ লাভ করছে আর আবেগ-বিবেক-অনুভূতি পৃথিবী থেকে
বিদায় নিচ্ছে। এখন আর লিখতে হয় না। কাগজ কলমের ব্যবহার তো নেই বললেই চলে। মুখের কথা
অটোমেটিক্যালি লেখা হয়ে যাচ্ছে যা প্রিয়জন বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে যথা সময়ে অতি দ্রুততার সাথে
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। ডাকবাক্স বা পোস্ট কার্ড হয়ত একদিন জাদুঘরে গিয়ে দেখে
আসতে হবে।
এক সময়ে স্নেহ মমতা আর গভীর ভালোবাসায় মন ডুবে থাকত প্রিয়জনের পাঠানো চিঠির দিকে। এ চিঠির
স্থান দখল করে নিয়েছে হোয়াটস এপ আর ই-মেইল অথবা ইন্সটাগ্রাম। তবে অবাক হওয়ার কিছুই নেই,
হতাশ হওয়ার কারন নেই। ইলেট্রনিক মিডিয়ার কারনে প্রিন্ট মিডিয়া অনেক পিছনে পড়ে যাচ্ছে। পত্রিকা
অফিসে ক্যামেরাম্যান/ ফটোগ্রাফার সাংবাদিকদের টর্চ লাইট দিয়ে খুজে পাওয়া যায়না। কারন তাদের
প্রয়োজনীয়তা দিন দিন কমে আসছে। এক সময় দেখা যাবে জাতীয় প্রেসক্লাবের বারান্দায় গিয়ে পত্রিকার
ফটো সাংবাদিকদের দেখে আসতে হবে। কথায় বলে, বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়।
তেমনিভাবে বিজ্ঞান পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সত্য, আবার অনেকাংশে বিমাতাসুলভ আচরন
করছে। গতিকে রোধ না করলেও মানুষের ব্যবহার সংকুচিত করছে। ’৭০ এর ১২ নভেম্বর ঘটে পৃথিবীর
ইতিহাসে সর্ববৃহৎ প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়। দশ লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু [ সরকারি হিসেবে ৫ লক্ষাধিক]।
ঐ সময়কার বেদনাদায়ক মর্মস্পর্শী ছবি দেখলে বাধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত চোখে পানি আসে। ’৫২ এর ভাষা
আন্দোলনের লাশের, ’৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের মিছিলের, ২৫ মার্চ কালো রাতের লাশের ছবি যা মানুষকে
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে।
’৭৪ এর দুর্ভিক্ষের নানা ছবি এমনকি কুড়িগ্রামের বাসন্তীর জাল পরা ছবি পত্রিকায় উঠে [মাছ ধরার জাল
পরে আব্রু ঢাকে] এতে তদানিন্তন শাসকগোষ্ঠীর গদি কেঁপে উঠে এবং দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠে। [
পরবর্তীতে এ ছবি যদিও প্রশ্নবিদ্ধ]
ইত্তেফাকের রশিদ তালুকদার, আফতাব আহমেদ, মোহাম্মদ আলম, দৈনিক বাংলার গোলাম মওলা,
কামারুজ্জামান, আবদুল ওয়াসে আনসারি, মনোয়ার আহমেদ ( পাখি মনোয়ার) , মুফতি মনির, জালালউদ্দীন
হায়দার, পাভেল রহমান ( এপি) এ বি এম রফিকুর রহমান ( রয়টার্স) সহ আরো অনেকের ছবি দেশে বিদেশে

প্রশংসিত হয়েছে। এদের ছবি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে স্বীকৃত। এ ছাড়া এখনও এ কে এম মহসীন,
খালেদ হায়দার অথবা বুলবুল আহমেদের দুষ্প্রাপ্য ছবি মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায়।
ঝড় বৃষ্টি তুফান আগুন পানির তোয়াক্কা না করে জীবন ঝুঁকি নিয়ে যেসব ফটো সাংবাদিকরা ছবি তুলে নিয়ে
আসতেন, তারাও চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছেন। মানুষ থেমে নেই। পরিবর্তনের আশায়, আবিষ্কারের নেশায়
বিরতিহীন ভাবে ছুটে চলছে এবং প্রকৃতিকে জয় করার চেষ্টা করছে। তারপরও বলতে হয় মায়ের দুধের
বিকল্প নেই। শাল দুধের উপকারিতার শেষ নেই। প্রেম পিরিতি মানুষের হাতে থাকলেও জন্ম মৃত্যু এখনও
একজনের হাতেই। ভাবার বিষয় হলো পৃথিবীতে আসতে লাগে ৯ মাস, যেতে কিন্তু ৯ সেকেন্ড ও না। বিজ্ঞান
এখানে নিরব।
মামা,
সাগরে সারাক্ষন কোটি কোটি ঢেউ উঠে, সব ঢেউ কিন্তু কিনারে আসতে পারেনা। বাগানে যত ফুল ফুটে, সব
ফুল কিন্তু সূর্যমুখীর মত হাসতে পারেনা। আকাশে লক্ষ তারার মধ্যে জ্বলে শুধু একটাই। শ্রাবণের যত
বৃষ্টি, কতটুকুই বা ফসলের প্রয়োজনে আসে। জীবনে কত প্রেম আসে, মানুষ একের অধিককে ভালোবাসতে
পারে না। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানবের মধ্যে মহামানবের সংখ্যা একেবারেই নগন্য। কোটি কোটি
বাঙ্গালীর মধ্যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী একজন, তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আবার শেখ
মুজিবুর রহমান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা, যা সারা পৃথিবীতে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
তিনি বিশ্ব শান্তি দূত হিসেবে জুলিও কুরি শান্তি পুরষ্কার পদকে ভূষিত। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায়
বিশ্বশান্তি পরিষদ আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে এই পদক প্রদান করা হয়। নেলসন
ম্যান্ডেলার মত বিরল মানবিক গুনের অধিকারী পৃথিবীতে দ্বিতীয়জন খুজে পাওয়া কঠিন। ২৭ বছর
কারাভোগের পর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা যিনি প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে
নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। কঠিন কারা নির্যাতনের পরও নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী এ কৃষ্ণাঙ্গ নেতা
কখনও অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি, নীতি বিচ্যুত হননি। কারা নির্যাতিত এ নেতা প্রেসিডেন্ট হবার
পরে একদিন শহরের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য সহকর্মীদের নিয়ে রাস্তায় বের হন। ক্ষুধা নিবারনের
জন্য সহকর্মীদের নিয়ে একটি হোটেলে খেতে বসেন। একই হোটেলে অন্য টেবিলে বসা একজনকে ডেকে
পাশের সিটে বসান এবং খাবার অর্ডার দেন। ভয়ে লোকটি খেতে না পারার কারনে ম্যান্ডেলা নিজের হাতে
তার মুখে খাবার তুলে দেন। খাবার পর চলে যাওয়ার চিন্তা করলে ভয়ে তার পা আর চলে না। ম্যান্ডেলা তার
লোকদের নিয়ে গতিপথ দেখিয়ে চলে যাওয়ার সুবন্দোবস্ত করে দেন। লোকটি কে, তার এ অবস্থা কেন
সহকর্মীদের এসব প্রশ্নের জবাবে ম্যান্ডেলা বলেন, এ লোক জেলখানার দারোয়ান। নির্যাতন শেষে আমি
পানি চাইলে এ লোকটি আমার গায়ে মুখে প্রশ্রাব করে দিত। প্রতিশোধ না নিয়ে তাকে ক্ষমা করে ক্ষমা ও
মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং পৃথিবীতে আজও স্মরনীয় হয়ে আছেন।
বিশ্বজননী মাদার তেরেসা অদ্বিতীয় যিনি মানবসেবার ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী
এ ক্যাথলিক সন্ন্যাসী মানবতা ও মনুষ্যত্ববাদের আদর্শ। ১৯৭৯ সালে ১০ ডিসেম্বর নরওয়ে বরসাতে
নোবেল প্রাপ্তদের জন্য ভোজসভার আয়োজন করা হয়। কিন্তু মাদার তেরেসা ভোজসভায় যোগদানে অনিচ্ছা
প্রকাশ করেন। এমনকি তার ভোজের টাকা ফেরত চান দরিদ্র জনগোষ্ঠীদের মধ্যে দান করার জন্য। কমিটি
তার এই মানবতার কথা জেনে ভোজসভা বাতিল করে ভোজ আয়োজনের খরচের সমুদয় টাকা মাদার তেরেসার
হাতে তুলে দেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবার কাজে ব্যয় করার জন্য। বিরল দৃষ্টান্ত।
যেখানে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, শিক্ষক এবং শিক্ষক নেতাদের অনেকে নানা অপকর্ম আর
সীমাহীন দুর্নীতিতে ডুবে আছে সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মরহুম
ডঃ মোহাম্মদ শফি দানবীর হিসেবে একক শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং
শিক্ষকতার পেশাকে মহিমান্বিত করেছেন। নিজ জীবনের সকল উপার্জন, অবসরের এবং জমি বিক্রির টাকা
নিজ কর্মস্থলের ভবন নির্মাণের জন্য দান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পুকুরের
উত্তর পাড়ে লাল ইটের ভবনটির কাজ অর্থের অভাবে আটকে ছিল ১৫ বছর। নিজের জমানো ৭০ লাখ টাকা

দিয়ে ভবনটির প্রান এনে দিলেন। নিজ বাড়ী বগুড়ার সান্তাহারে বিপি হাইস্কুলে ২০০১ সালে বাবার নামে চালু
করেন আব্দুল লতিফ ছাত্রবৃত্তি কল্যান ফান্ড। মায়ের নামে পাশের কলেজ আহসানউল্লাহ ইন্সটিটিউশনে
চালু করেন আমেনা খাতুন বৃত্তি কল্যাণ ফান্ড। ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ লাখ টাকায় গঠন
করেন আমেনা লতিফ ট্রাষ্ট ফান্ড। এখান থেকে প্রতি বছর মৎস্য বিজ্ঞান বিভাগের ৩ জন মেধাবী
শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়। নিজ নামে গঠন করেন ডঃ মোহাম্মদ শফি ট্রাষ্ট ফান্ড। এখান থেকেও ২
জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির সাথে জড়াননি অথচ পাবলিক
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও একটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন এর সভাপতি হওয়ার
জন্য ইচ্ছা পোষণ করেন এমনকি লবিং করেন। ডঃ মোহাম্মদ শফি শ্রেণীকক্ষে পাঠদান ও বিভাগের
উন্নয়ন নিয়েই জীবন কাটিয়েছেন।

সকল সেক্টর কমান্ডার খেতাব পেলেও এক ব্যক্তি খেতাব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন যিনি স্বাধীন দেশের
প্রথম রাজবন্দী। তার অপরাধ ছিল যুদ্ধ শেষে যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের বিপুল
অস্ত্রভাণ্ডার লুট করছিল তখন তিনি বাধা দিয়েছিলেন। যশোহর বেনাপোল সীমান্তে রুখে দাঁড়িয়েছিল। এ
অপরাধে যিনি অপরাধী তিনি হলেন মেজর এম এ জলিল। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টর
কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। গোটা মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের ভিত্তি ছিল হিট এন্ড রান
পদ্ধতি যার উদ্ভাবক ছিলেন মেজর জলিল, যা গেরিলাযুদ্ধের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। অথচ সেই মেজর
জলিল অনেক অবহেলিত ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন এবং ১২ নং ট্যাঙ্ক ক্যাভালরি
রেজিমেন্ট অফিসার হিসাবে তৎকালীন পাক-ভারত যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। আসলে সবাই সব কিছু
পায়না। কথায় আছে সব ঝিনুকে মুক্তো হয় না, সব পাথরে চুনি হয়না।
মামা,
গত ২০ জুন ২০২২ বর্ষণ মুখর সন্ধ্যায় বেইলী রোডের সিটি ক্লাবে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ’৮২
ব্যাচের সতীর্থদের নিয়ে আড্ডা ও নৈশ ভোজ। আমেরিকা প্রবাসী মাহফুজ ও মিসেস মাহফুজের সৌজন্যে এ
আনন্দঘন আড্ডার আয়োজন। আয়োজক সদালাপী মিষ্টিভাষী, প্রচারবিমুখ সাবেক সচিব CU ’82 ঢাকাস্থ
সভাপতি জামাল উদ্দিন আহমেদ। শুরুতে জামাল সূচনা বক্তব্য রাখে এবং নান্দনিক ভাষায় অনুষ্ঠানের শানে
নুজুল তুলে ধরে। আকতার ও আফসার এ খানের শব্দ দূষনে অনেকের কিঞ্চিত মনোযোগ নষ্ট হলেও
জামালের কাব্যিক আলোচনায় সবাই মুগ্ধতা প্রকাশ করে। বার বার এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য
সবাই তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানায় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। বিদায়ী বন্ধু মাহফুজের হৃদয়গ্রাহী ও
আবেগঘন বক্তব্যে পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক মায়াবী স্মৃতি উঠে আসে। অনেকের
চোখে জল টলমল করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্রজীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য অদম্য আগ্রহ জেগে উঠে।
অফিসার্স ক্লাবে আকতার এর ছেলের বৌভাত অনুষ্ঠানের সস্ত্রীক দাওাত সবাই সাদরে গ্রহন করে এবং
বান্ধবীদের আনার বাড়তি অনুমতিদানের কথা শুনে বাতেন ও রওনাক নড়ে চড়ে উঠে। তাদের চোখে মুখে
আনন্দের বার্তা ভেসে উঠে। ঠোটকাটা বন্ধুদের ঠোঁটের আগায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত “লেসু” শব্দটি
চলে আসে। সংগঠনের জন্য নিবেদিতপ্রান হিসাব শাস্ত্রের আবু সাদেক চাঁদাবাজির পদ থেকে ইস্তফা দিতে
চাইলে তুমুল বাধার মুখে পড়ে। তবে ব্যক্তির পরিবর্তন না করে চাঁদাবাজের পরিবর্তে সম্মানিত কালেক্টর
নাম রাখার প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। অতি সম্প্রতি মক্কা মদিনা ফেরত ওবায়েদ (সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ
সুপার) অনাহুতভাবে ভাবীদের টেবিলে গিয়ে খোশ গল্পে মিলিত হলে বন্ধুদের অনেকে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠে।
বাহার, কামরুল হাসান, সাইফুদ্দিনদের ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম। তবে ওবায়েদ পূর্ব প্রস্তুতি
ছাড়াও আসর জমিয়ে তোলে। প্রখ্যাত গীতিকার কে জি মোস্তফার সেই গানটি যেন কানে বেজে উঠে,
ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি বলে যায়
তোমায় আমায় সারাটি জীবন নীরবে জড়াতে চায়।

তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো ভেজাল মামা সাইফুদ্দিনের সাথে আফসার এ খানের বউয়ের একটি ছবি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তুমুল সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিন্দুকেরা বলতে চায়
নিজের জমিতে চাষবাস না করে অন্যের জমিতে নিড়ানী কোনমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। আফসার হতাশ।
বোকারাম আফসার শিয়ালের কাছে মোরগ বর্গা দিয়ে এখন শুধু আফসোস করছে।
মামা, এ জগাখিচুড়ি আলোচনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের স্মরণ এবং রঙ্গরসের স্মৃতিচারণ ছাড়া অন্য কিছু
নয়।

মামা,
একটা গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করার চেষ্টা করছি।
একবার হিটলার একজোড়া মুরগি নিয়ে সংসদ কক্ষে ঢুকলেন। ঢুকে সবার সামনে একটা একটা করে পালক
উপড়াতে লাগলেন। মুরগী দুটো তীব্র যন্ত্রনায় কোঁকাতে লাগল। তবুও হিটলারের ভ্রুক্ষেপ নেই। মুরগী
গুলোকে পালক শূন্য করে হিটলার অবজ্ঞাভরে সংসদ কক্ষের চকচকে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললেন। তারপর
হিটলার পকেট থেকে মুঠো মুঠো গমের দানা বের করে মুরগী দুটোর সামনে ছড়াতে লাগলেন। মুরগী দুটো
যন্ত্রনা ভুলে একটার পর একটা গমের দানা খুঁটে খুঁটে খেতে লাগল। হিটলার হাঁটতে হাঁটতে সমানে গমের দানা
ছড়িয়ে দিচ্ছেন আর মুরগী দুটো তার পিছন পিছন গমের দানা খুঁটে খুঁটে খেতে খেতে হেঁটে চলেছে। হিটলার
দম্ভের সাথে গর্বভরে বলতে লাগল, “মাননীয় স্পীকার,এ মুরগী গুলো হলো গণতান্ত্রিক দেশের জনগণের
মতো। তাদের শাসক আর সরকার প্রথমে একটা একটা করে পালক উপড়ে নেয়, পরে সব লুটে নিয়ে জনগণকে
প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেয়। তারপর দুই একটা গমের দানা ছড়িয়ে ছিটিয়ে জনগণের মাসিহা সেজে মাথার উপর
ক্ষমতার ছড়ি ঘোরায়
মামা,
কালের খেয়ায় গত বিগত হয়ে চলে যায়। ঘটনার পর ঘটনা। একটি ঘটনাকে চাপা দেয়ার জন্য আরেকটি
ঘটনার আবির্ভাব। এরই মাঝে কত ঘটনা লেখা হয় শতাব্দী সহস্রাব্দীর পাতায়। সবই কালক্রমে ইতিহাসের
অংশ হয়ে দাঁড়ায়। আমি আপনি ভুলে যেতে পারি শাসনের ভারে কিংবা ক্ষমতার লোভে কিন্তু ইতিহাস থেকে
কোন ঘটনাকে মুছে ফেলা যায়না। আমরা শুধু ইতিহাসের স্বাক্ষীমাত্র, তাও ক্ষণিকের। কারন যারা ছিল
তারা আর নেই। যারা আছে তারা আছে যাবার অপেক্ষায়। যারা আসবে তারা কিছুকাল থাকবে। এ আসা
যাওয়ার সরাইখানায় আমরা কেবলমাত্র অস্থায়ী বাসিন্দা। যেদিন থাকবো না সেদিন হয়ত বেদনার সুরে
বেজে উঠবে কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। তবে নিরব থাকা ভাল। নিরবতার বিকল্প নেই।
বোবার শত্রু নেই। অনেক কিছু জানলেও প্রকাশ করতে নেই। সময় কিন্তু এক রকম যায়না। জীবনটা বড়
ছোট। তাই শঙ্কিত প্রাণের নিভৃত ভাবনার অতলান্তে মায়াবী পৃথিবীর বুকে জনশূন্য এক খন্ড জমির উপর
দাঁড়িয়ে আজ একাকী ভাবছি

আবার হবেতো কথা
এই কথা শেষ কথা নয় তো??

ইতি

আপনারই ভাগিনা

চলবে

ইবাংলা/জেএন/৯ আগস্ট,২০২২

ভাগিনার খোলা চিঠি (১২)