পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকেই প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে আসছে। দীর্ঘ সময় ধরে যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী সময় নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশে বিভিন্ন কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে।
পৃথিবী আধুনিক যুগে প্রবেশ করার পর প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে মানুষ্য দ্বারা সৃষ্টি বিভিন্ন আধুনিক উপাদানের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে ব্যাপক পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করছি। বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপে এবং আমেরিকাতে প্রচন্ড দাবদাহ এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে বরফের যে পাহাড় রয়েছে তা গলতে শুরু করেছে, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন বিভিন্ন নিয়ামকের উপর নির্ভরশীল; যেমন- জৈব প্রক্রিয়াসমূহ, পৃথিবী কর্তৃক গৃহীত সৌর বিকিরণের পরিবর্তন, ভূত্বক গঠনের পাততত্ত্ব (plate tectonics), আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, ইত্যাদি। তবে বর্তমান কালে সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে জলবায়ু পরিবর্তন বললে সারা পৃথিবীর মানবিক কার্যকর্মের কারণে জলবায়ু পরিবর্তন বোঝায় যার মধ্যে ভূমণ্ডলীয় উষ্ণতা বৃদ্ধি বেশি পরিচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, বাতাস, ইত্যাদি পরিবর্তিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে গ্রিনহাউস এফেক্ট। শক্তি উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানির পোড়ানোর ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন,মিথেন সহ নানা ধরনের ক্ষতিকারক গ্যাস বৃদ্ধি পায় এবং এই গ্যাস গুলো আমাদের বায়ুমণ্ডলকে উৎতপ্ত করে চলেছে। ফলাফল স্বরূপ মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাচ্ছে,যার কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী নিম্ন অঞ্চল গুলো প্লাবিত হচ্ছে।
মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া মেরু অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: এসিড বৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের আরেকটি বড় কারন হচ্ছে অধিক পরিমাণে বৃক্ষ নিধন এবং নতুন নতুন শিল্প কারখানা প্রতিস্থাপন ।
আরও পড়ুন…চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ জ্ঞানভিত্তিক সামাজিক আন্দোলনের ‘ঢাকা ঘোষণা’
এইসব কারখানা থেকে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত করে চলছে। এই সকল গ্যাস পরিবেশ এবং জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অন্যদিকে বৃক্ষের রয়েছে এইসকল ক্ষতিকর গ্যাস গ্রহণ করে, সেগুলোকে অক্সিজেনে রুপান্তরিত করার ক্ষমতা। কিন্তু আমরা সেই বৃক্ষ গুলোকেও নিধন করে চলেছি। বনের পর বন উজাড় করে চলছে শিল্প কারখানা এবং নতুন নতুন ভবন তৈরি করা।
জলবায় পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ি আমরা মানুষরাই। তাই আগে আমাদের ভুল গুলো সুদরে নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে অনেক পরিমাণে বৃক্ষ রোপন করতে হবে এবং যে সব শিল্প কারখানা বায়ুতে বিষাক্ত ও ক্ষতিকর গ্যাস গুলো নির্গমন করে চলছে, সেগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অত:পর আশাকরা যায় এই সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পৃথিবীর জলবায়ু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে।
বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলতে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে যে অস্থায়ী কিংবা স্থায়ী নেতিবাচক এবং ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তার যাবতীয় চুলচেরা বিশ্লেষণকে বোঝাচ্ছে।
ইউএনএফসিসিসি বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে মানুষের কারণে সৃষ্ট, আর জলবায়ুর বিভিন্নতাকে অন্য কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন বোঝাতে ব্যবহার করে। কিছু কিছু সংগঠন মানুষের কারণে সৃষ্ট পরিবর্তন সমূহকে মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন বলে। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বব্যাপি জলবায়ুর পরিবর্তন শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণেই নয়, এর মধ্যে মানবসৃষ্ট কারণও সামিল। এই নিবন্ধে “বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন” বলতে শ্রেফ প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ু পরিবর্তনকে বোঝানো হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের বিপর্যয়ের এই ঘটনাকে বাংলাদেশ সরকারের বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নব্বইয়ের দশকে প্রণীত ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ম্যানেজমেন্ট এ্যাকশন প্ল্যান-এ দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কোনো দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সত্যিই পড়ছে কিনা, তা চারটি মানদন্ডে বিবেচনা করা হয়:
১. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
২. কোথায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেশি হচ্ছে
৩. সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা কোথায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
৪. ক্ষতিগ্রস্ত দেশটি ক্ষতি মোকাবিলায় বা অভিযোজনের জন্য এরই মধ্যে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশে একাধারে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা সমস্যা, হিমালয়ের বরফ গলার কারণে নদীর দিক পরিবর্তন, বন্যা ইত্যাদি সবগুলো দিক দিয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং হচ্ছে। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রাও অনেক অনেক বেশি।
বঙ্গোপসাগরের সাথে বাংলাদেশের রয়েছে ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলভাগ থাকায় দিনে দিনে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ডুবে যাবার আশঙ্কায় রয়েছে বাংলাদেশ।UNFCCC’র দেয়া তথ্যমতে, বিংশ শতাব্দিতে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা ১০-২০ সেন্টিমিটার বেড়েছে এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ আরো ১৮-৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়লে মালদ্বীপসহ তলিয়ে যাবে উপকূলবর্তী দেশ বাংলাদেশও।
জাতিসংঘের আন্তসরকার জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যানেল- এর তথ্যমতে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের অন্তত ১৭% ভূমি সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে৷ ‘দ্যা সায়ন্টিফিক কমিটি অন এন্টার্কটিক রিসার্চ’ (SCAIR) জানিয়েছে, যে হারে এন্টার্কটিকার বরফ গলছে, তাতে ২১০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৫ ফুট।
আরও পড়ুন…প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে চা শ্রমিকদের উল্লাস,শ্বতস্ফূর্তভাবে কাজে ফেরার ঘোষণা
বিগত দিনের পরিসংখ্যানের প্রায় দ্বিগুণ এই হিসাবের প্রেক্ষিতে ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা DFDI এপরিমাণ উচ্চতাবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের প্রায় এক পঞ্চমাংশ সমুদ্রে তলিয়ে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত তালিকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এরকম অকষ্মাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ দেশের প্রায় ৮%-এরও বেশি নিম্নাঞ্চল ও প্লাবনভূমি আংশিক অথবা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়বে। এছাড়া ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড বা WWF-এর মতে সমৃদ্রস্তরের উচ্চতাবৃদ্ধিতে ঢাকাও আক্রান্ত হতে পারে।
এইসব ভবিষ্যত সংশ্লিষ্টতার প্রেক্ষিত পেরিয়ে বর্তমানেই (২০০৯) সুন্দরবনে সর্বপ্রথম, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি অনুভূত হয়।কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্যমতে, ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত সমুদ্র, প্রতি বছর ৩ মিলিমিটার (০.১২ ইঞ্চি) করে বাড়ছিল, কিন্তু পরবর্তি দশকেই প্রতি বছর ৫ মিলিমিটার (০.২ ইঞ্চি) করে বাড়া শুরু হয়েছে।
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে সার্কের “আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র”(SMRC)-এর একটি গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, হিরণ পয়েন্ট, চর চাঙ্গা, এবং কক্সবাজারে জোয়ারের পানির স্তর প্রতি বছর, যথাক্রমে ৪.০ মিলিমিটার, ৬.০ মিলিমিটার এবং ৭.৮ মিলিমিটার বেড়েছে।
এদিকে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের চেয়েও আরো বেশি হারে ডুবে যাচ্ছে। কারণ প্রতি বছর বঙ্গোপসাগর উপকূলের এলাকাসমূহের মাটি দেবে, বসে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই একটি গবেষণা থেকে ভারতের কলকাতা শহরে, মাটি বসে যাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া আরো দুটি গবেষণায় ভবিষ্যতে লখনৌ এবং পাটনার ভূমি বসে যাবার সম্ভাব্যতা দেখানো হয়েছে।
যদিও বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে, ভূমি, প্রতি বছর ৫মিলিমিটার বসে গেলেও, পলি জমে আরো ৭মিলিমিটার উঁচু হয়ে যায় ভূত্বক। কিন্তু মানবসৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে নদীর পানি বা বন্যার পানি সর্বত্র পৌঁছাতে পারে না, ফলে পলি পৌঁছতে পারছে না সেসব স্থানে। আর তাই ভূমি বসে যাবার তুলনায় সব স্থানে ভূমি উঁচু হচ্ছে না। এ গবেষণা সঠিক হলে, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির হারের চেয়ে অতিরিক্ত হারে বাংলাদেশ ডুবে যাবে; এতে যেমন মানুষের হস্তক্ষেপ আছে, তেমনি আছে প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন।
মালদ্বীপ, টুভ্যালু, টোবাগো – এদের সবার ক্ষেত্রেই এই সবগুলো মানদন্ডই কার্যকর নয়। তাছাড়া মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের অনেক জেলার জনসংখ্যার চেয়েও কম। তাই এই চারটি মানদন্ডেই বাংলাদেশ, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় শীর্ষে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচ-এর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতির বিচারে শীর্ষ ১০টি ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে প্রথমেই অবস্থান করছে বাংলাদেশ। এই সমীক্ষা চালানো হয় ১৯৯০ থেকে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ১৯৩টি দেশের উপর। উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ২০০৭ এবং ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ততার বিচারে বিশ্বব্যাপী গবেষকগণ বাংলাদেশকে পোস্টার চাইল্ড হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন।সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চল থেকে ২০৫০ সাল নাগাদ ৩ কোটি মানুষ গৃহহীন হতে পারে৷ ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সংবাদ মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১-১.৫ কোটি মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন…ভিনদেশী পোশাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় উচ্চ আদালতকে স্যালুট জবি শিক্ষার্থীদের
ইতোমধ্যেই ঘূর্ণিঝড় আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিপুল সংখ্যক (প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ) মানুষ ছেড়েছে খুলনার কয়রা এলাকা; পাড়ি জমিয়েছে ঢাকা, রাঙ্গামাটি কিংবা খুলনা সদরে। ভোলাতে রাজাপুর ইউনিয়নের তথ্যমতে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ৬৫০টি পরিবার ঘর-জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে সাতক্ষীরা জেলায় প্রায় ৪২,০০০ মানুষ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে হঠাৎ বন্যায় লোকালয়ে লোনাপানি ঢুকে যাবার কারণে।
খুলনার সুন্দরবন এলাকার পশ্চিমাঞ্চলের আংটীহারা গ্রামে, শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে দেখতে পাওয়া একগ্রাম মুন্ডা থাকলেও,২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের নদীভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে গেছে তারা। তাদের পুরো গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে।
এসকল উদ্বাস্তুর কারণে বড় বড় শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপ পড়েছে রাজধানী শহর ঢাকায়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ছিলো ১,৭৭,০০০, সেখানে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় ১,৬০,০০,০০০। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২ কোটি।
এছাড়াও মুহুর্মুহু নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তি পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে অসময়ে বাবা-মাকে হারিয়ে এতীম হয়ে যায় অনেক শিশু। আর্থিক অনটন ও জীবন-জীবিকার উৎস হারিয়ে পড়া সেসব পরিবারের শিশুরা ভোগে নানা রোগে-শোকে। বন্ধ হয়ে যায় তাদের লেখাপড়া, জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যেতে বসে সেসব শিশুরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগে মানুষদের সহায়-সম্বল হারাতে হয়। গৃহস্থ পরিবারের গরু, ছাগল, মহিষ, হাঁস, মুরগি, বৃক্ষাদি, শস্য, মৎস্য সম্পদ, শস্যবীজ, গবাদি পশুর শুকনো খাদ্য, এমনকি মাছ ধরার জাল, ঝুড়ি, কিংবা জমি চাষের লাঙ্গল-জোয়াল হারিয়ে যায় বড়সড় ঝড় কিংবা জলোচ্ছাসে।
বড় ধরনের জলোচ্ছাসের পর গবাদি পশুর শুকনো খাদ্যের আকালে পড়ে অনেক পরিবার। এছাড়া সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের পর লবণপানির প্রভাবে লবণাক্ত জমি হয়ে পড়ে অনুর্বর। ফলে কখনও সাময়িক, কখনও দীর্ঘ সময়ের জন্য এক বিরাট আর্থিক অনটন কিংবা দুর্যোগের মুখোমুখি হোন দুর্যোগ- আক্রান্ত মানুষেরা।
জাতীয় পর্যায়ে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রয়োজনে বাংলাদেশকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে। নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে ও চলমান দুর্যোগ মোকাবিলা করতে বিদ্যমান অবকাঠামোগত স্থাপনায় আনতে হয় নকশাগত ও আবকাঠামোগত পরিবর্তন। যেমন: লোনা পানি ঠেকাতে দেশের উপকূলীয় পোল্ডারগুলোর নকশা পাল্টে মেরামত ও নতুন পোল্ডার তৈরি করা এবং নদীর পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি ও আচরণগত পরিবর্তনে সেচ প্রকল্পের সংস্কার সাধন।
তাছাড়া উপর্যুপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির সংস্কার কিংবা পুণর্নির্মাণে প্রতি বছর বাজেটে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করতে হয়। দাতা সংস্থাসমূহ এই ব্যয় বহন করতে অস্বীকৃত হলে বাংলাদেশ সরকারকে অভ্যন্তরীণ আয় থেকেই এসকল ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে অর্থঘাটতি দেখা দেয়। ফলে সরকারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হয়।
অথচ যেভাবে চাষযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে তাতে বাংলাদেশ সরকারের মূল আয়ের উৎসগুলো বন্ধ হতে চলেছে। কৃষিভিত্তিক উৎপাদন কমে গেলে সরকার রাজস্ব এবং রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ হারিয়ে ফেলবে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনীতি আয়ের তুলনায় ব্যয়ের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিরাট অংশ মৎস্য সম্পদের উপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা থেকে শুরু করে চিকিৎসা খাতও এর উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে প্রায় ১,৪৭,০০০ হেক্টর পুকুর, ৫,৪৮৮ হেক্টর বাওর এবং ১১,০০,০০,০০০ হেক্টর চিংড়ি ঘেরে মাছ চাষ হয়। এছাড়া প্রায় ৪৪,৭০,০০০ হেক্টর মুক্ত জলাশয়ে (নদী, হাওর, বিল, খাল) ২৫০ প্রজাতির মাছের বসবাস, যার মধ্যে ২৪টি প্রজাতির প্রজননও এখানেই হয়ে থাকে। এই বিপুল মৎস্যসম্পদ আজ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে। এই বিপুল সম্পদে আঘাত লাগলে দেশের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জার্মান ওয়াচের গবেষণা প্রতিবেদন (২০১০) অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বাৎসরিক ক্ষতির পরিমাণ ২,১৮৯ মিলিয়ন ডলার, জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে যা ১.৮১% নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
ইবাংলা/জেএন/২৮ আগস্ট,২০২২