দ্রব্যমূল্য ও মানুষের জীবন একইসূত্রে গাঁথা। বিভিন্ন অসাধু সিন্ডিকেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস। তারা লজ্জায় না পারছে হাত পাততে, না পারছে কিছু বলতে। অধিকাংশের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরায় । প্রতিনিয়ত সবাইকে ছুটতে হচ্ছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে । তাই তাদের প্রশ্ন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সিন্ডিকেটের লাগাম টানবে কে?
খাদ্য-পণ্যের উৎপাদনের অভাবে বিশ্বে কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি। বরং দুর্ভিক্ষ হয়েছে অসাধু সিন্ডিকেটের মজুতদারিতে । ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিশ্বজুড়ে একদিকে মানুষ না খেয়ে হাড্ডিসার হয়ে মরলো, আরেক দিকে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী সমুদ্রে পণ্য নিক্ষেপ করলো। ৪৩ ও ৭৪ এর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের কথা কে ভুলে গেছে? এ দেশে গুজব ছড়িয়ে লবণ নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড, তেল নিয়ে তেলেসমাতি, ডিম ও সারের কৃত্রিম সংকট ঘটিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফার চেষ্টা সিন্ডিকেটের কারসাজির অকাট্য প্রমাণ। এমনকি ওষুধ সিন্ডিকেটতো তার জলজ্যান্ত উদাহরণ । এমনকি পচনশীল দ্রব্য পেঁয়াজ গুদামজাত করে পরে পচিয়ে নদীতে ফেলে দেয়ার মতো দৃশ্যও দেখতে হয়েছে আমাদের । বাজার সিন্ডিকেট কতটা নিচু, লোলুপ ও নিষ্ঠুর হলে এ ধরনের ঘৃণ্য কাজে উদ্ভুদ্ধ হতে পারে?
আরোও পড়ুন………তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান
অর্থনীতির ভাষায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মূল কারণ চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যে ঘাটতি হলেও এই দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জোগানের ওপর কারুকাজ করে সিন্ডিকেট বৃত্তে সুরক্ষিত প্রথিতযশা অদৃশ্য বেনিয়ারা। তাই দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সিন্ডিকেট গুদামে আগুন দাগাতে হবে। কিন্তু সিন্ডিকেট নামক বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধঁবে কে? গবেষণায় দেখা গেছে – ১৯৭৩ এ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী এম.পি ছিলো প্রায় ১৮%, ১৯৯১ সালে ৩৮% , ২০১৪ সালে ৬২% অর্থাৎ ১৮২ জন এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদে তার চেয়েও বেশি ৷ রাষ্ট্রে যেখানে প্রায় ৬২% এম.পি ব্যবসায়ী, সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের কাছে ব্যবসা আর মুনাফাই প্রাধাণ্য পেলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে কে? তাই দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে রাজনীতি কি এখন নীতির রাজা হবে নাকি রাজার নীতি হবে, এটাই সবার প্রশ্ন।
২০২২ থেকে করোনার সাথে যুদ্ধে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জীবন এমনিতে চরম সঙ্কটে। এর মধ্যে মহামারীর চেয়েও ভয়ংকর হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি। এ ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস চরমে উঠায় ঘরে ঘরে বোবাকান্নার মত নিরব আর্তনাদ হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও টিকা নিয়ে হয়তো করোনাভাইরাস ঠেকানো সম্ভব হয়েছে কিন্তু নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি ঠেকাবে কে ? ভুক্তভোগীদের মতে দ্রব্যমূল্যের পাশাপাশি ভর্তুকির অজুহাত দেখিয়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল বৃদ্ধি করার পেছনেও কি দূর্নীতিবাজ, টাকা পাচারকারী মুনাফাখোর সিন্ডিকেট জড়িত? তাই ভোক্তাদের প্রশ্ন – নিশ্বাস চলে গেলেই কি সরকার এসব সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরবে?
বৈশ্বিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির অজুহাত দেখালেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে ব্যবসায়ীরা কি স্বেচ্ছায় কখনো দাম কমিয়েছে? নিশ্চয় না, এমনকি সরকার কর্তৃক পণ্যের মূল্য নির্ধারণ, ভর্তুকি ও আমদানি শুল্ক কমালেও দাম কখনো কি কমেছে? এদিকে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, দাম বাড়ানোর জন্য শুধুমাত্র তারা দায়ী কিভাবে ? বরং তাদের উল্টো প্রশ্ন- বড় বড় আমদানি ও রপ্তানিকারক, বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ যারা খাদ্য পণ্যের বিভিন্ন সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে তাদের বিরুদ্ধে কখনো কি কোনো অভিযানের খবর শোনা গেছে ? নাকি এসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অর্থ ও ক্ষমতার জোর রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী?
নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক কারণে যতটুকু বাড়ে তার তুলনায় ঢের বেশি বৃদ্ধি হয় অসাধু সিন্ডিকেটের অনৈতিক কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সুযোগ বুঝে প্রকৃত মূল্যের তুলনায় দ্বিগুন, তিনগুন এমনকি পাঁচগুণ লাভে পণ্য বিক্রির ফলে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে উৎপাদনকারীকে ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব সিন্ডিকেট। এসব দেখেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্বিকারত্ব প্রমাণ করেই কি শর্ষের মধ্যে ভূত আছে ?
দ্রব্যমূল্যের চণ্ডালতায় জর্জরিত নিম্ন মধ্যভিত্ত। অল্প দামে পণ্য কিনতে তাদের একমাত্র ভরসা এখন গরীবের বউ বাজার ও টিসিবির ট্রাক । দেশের মাথা পিছু আয়ে সকলে সচ্ছল হলেও লাগামহীন দামে চোখে অন্ধকার দেখে। সিন্ডিকেটের কারণে অর্থনীতির সাধারণ সূত্রগুলোও বাজারে অচল। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ফলে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া, বৈশ্বিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধি, সরবরাহ সঙ্কট, উৎপাদনে ঘাটতি ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি দেশের বাজার অস্থির হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলেও প্রধান কারণ কিন্তু বাজার সিন্ডিকেট । তাই অবৈধ মজুদদারদের সমূলে উৎখাত না করে দাম নির্ধারণ ও টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য বিক্রি করলেই কি সংকটের সমাধান সম্ভব?
আরোও পড়ুন……ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীদের সহজে চাকরি হয় না
বাঙ্গালী ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে অতীতের ন্যায় দল মত নির্বিশেষে এক হয়ে কাজ করলে এই বৈরি অবস্থা থেকে বের হতে বেশি সময় লাগবে না। করোনা ও রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ্বের সর্বোচ্চ জিডিপির দেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক ব্যয় সংকোচিত হয়েছে, তাই দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হওয়ায় শুধুমাত্র সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে এই সংকটে সকলের এগিয়ে আসা উচিৎ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রণোদনা, পণ্যের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য , আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে সমন্বয় ও পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি বন্ধ সংকট উত্তরণে অপরিহার্য।
পদ্মা সেতুর মত সরকারের ইতিবাচক কাজে মানুষের উচ্ছ্বাস থাকলেও নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যে মানুষ অতিষ্ঠ । তাই সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে করোনার মত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন এবং সর্বোপরি অবৈধ মজুদদার সিন্ডিকেটের মূলোৎপাটন করে বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষাই হোক সংকট উত্তরণের প্রথম ও একমাত্র কাজ।
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লেখক, গবেষক ও সমাজকর্মী।
সভাপতি – সিএসই এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ইবাংলা/আরএস/৩ সেপ্টেম্বর,২০২২