তেল ও চিনির দাম সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু খুচরা বাজারে নির্ধারিত দামের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এ দুটি পণ্য। এখন আবার দাম বাড়াতে চান মিল মালিকরা। সপ্তাহখানেক আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া তাঁদের প্রস্তাব আমলে নিয়ে পর্যালোচনা করছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন।
মিল মালিক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সামনের দিনগুলোতে দাম বাড়বে তা নিশ্চিত। তবে কত বাড়বে এটাই এখন পর্যালোচনার বিষয়। এ ক্ষেত্রে আমদানিকারক কম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, বর্তমান খরচ অনুসারে তেল-চিনির দাম কেজিপ্রতি আরো চার থেকে ছয় টাকা বাড়ানো দরকার। সেভাবেই প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজার, দেশে আমদানি পরিস্থিতি ও শুল্ক পর্যালোচনা শেষে আগামী সপ্তাহের শুরুতে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ বিষয়ে আগামী রবিবার বৈঠক হবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হতে পারে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
দেশের ভোজ্য তেলের দাম সর্বশেষ নির্ধারিত হয় গত সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে। ওই সময় সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটারে চার টাকা বাড়ানো হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে এ দাম নির্ধারণ করা হয়। মিল মালিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অপরিশোধিত সয়াবিন ও অপরিশোধিত পাম তেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর বিবেচনায় পরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এটিকে দাম বৃদ্ধি বলছেন না মিল মালিকরা। তাঁরা বলছেন, গত জুলাইয়ে সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি চার টাকা কমানো হয়েছিল। সেটাই আবার আগের জায়গায় নিয়ে আসা হয়েছে। তেলের বর্তমান দাম নির্ধারিত হয়েছিল গত মে মাসে। তাঁরা বলছেন, মে মাসে যে মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে সেই মূল্য পুনর্বহাল করা হয়েছে।
সর্বশেষ নির্ধারিত দাম অনুসারে দেশের বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ১২৯ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৫৩ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। এ ছাড়া বোতলজাত প্রতি পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৭২৮ টাকা এবং খোলা প্রতি লিটার পাম সুপার তেল ১১৬ টাকা দরে বিক্রি হবে। কিন্তু বাজার ঘুরে দেখা যায়, এই দাম মানা হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রেই।
অন্যদিকে নতুন করে চিনির দাম নির্ধারণ করা হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর। ওই সময় চিনির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মিল মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি কেজি খোলা চিনি ৭৪ টাকায় এবং প্যাকেটজাত চিনি ৭৫ টাকা দাম বেঁধে দেয়। পরে বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়। কিন্তু চিনির ক্ষেত্রে একই অবস্থা। খুচরা বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, গত মাসে চিনির দাম প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এই মূল্য গত বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি।
বাজারের এমন অবস্থায় আবারও তেল-চিনির দাম বাড়ানোর আলোচনা উঠেছে। এ জন্য বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন গত মঙ্গলবার একটি বৈঠকও করেছে। এ সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ছাড়াও মিল মালিকদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তবে সে বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী রবিবার আরো একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, গত ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের অপরিশোধিত চিনির দর ছিল প্রতি মেট্রিক টন ৪৩৭ মার্কিন ডলার ৩৯ সেন্ট। আর অপরিশোধিত সয়াবিনের দর ছিল টনপ্রতি এক হাজার ৩১৪ ডলার।
এক মাস আগে চিনির দর ছিল ৪১৩ ডলার ১৪ সেন্ট। টনপ্রতি দাম বেড়েছে ২৪ ডলার ২৫ সেন্ট বা ৫.৮৭ শতাংশ। আর সয়াবিনের দর ছিল এক হাজার ৩৪৫ ডলার। অর্থাৎ প্রতি টনে ৩১ ডলার বা ২.৩০ শতাংশ কমেছে।
এ ছাড়া মালয়েশিয়ার অপরিশোধিত পাম তেলের দাম গত ২৬ সেপ্টেম্বর ছিল প্রতি টন এক হাজার ১৯৫ ডলার। এক মাস আগে ছিল এক হাজার ১২২ ডলার। টনপ্রতি দাম বেড়েছে ৭৩ ডলার বা ৬.৫১ শতাংশ।
মিল মালিকদের প্রতিনিধিরা বলেছেন, নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষ আমদানিকারকরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। কারণ এত দিন যে পণ্য বিক্রি হয়েছে তা আগের আমদানি করা। এতে কিছুটা দাম কম রাখা গেছে। এখন যে পণ্য আসছে তা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কেনা। খরচ হিসাব করলে বর্তমান দামে বিক্রি করা যায় না। তাঁরা বলছেন, খরচ হিসাব করলে আমদানির সব পণ্যই লিটার বা কেজিপ্রতি চার থেকে ছয় টাকা বাড়ানো উচিত। এ ক্ষেত্রে একেক প্রতিষ্ঠানের খরচ একেক রকম। ফলে প্রস্তাবগুলোও ভিন্ন ভিন্ন।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা এখনো পর্যাপ্ত তথ্য পাননি। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক, কাস্টমস, রয়টার্স ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যমের দাম, আমদানি, মজুদসহ নানা তথ্য পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি এখনো। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আবারও বসবেন। তবে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারের দামের তথ্য বলছে দেশে বাড়ানোর প্রস্তাব যৌক্তিক। তবে সেটা কত তা বলা যাচ্ছে না।
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘লকডাউনের ক্ষতি মানুষ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে আরেক দফা দাম বাড়ালে আরো চাপে পড়বে ভোক্তারা। এ ছাড়া বেঁধে দেওয়া দামেই যেন ভোক্তারা পণ্য কিনতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ী ও ভোক্তা—উভয়ের স্বার্থই দেখতে হবে সরকারকে।’