বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৯ সালের ৫ মার্চ থেকে টানা এক যুগ কারাগারে রয়েছেন। তিন মামলায় হয়েছেন দণ্ডিত। এর মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় তাকে দেওয়া হয়েছে ফাঁসির দণ্ড। অবৈধ অস্ত্র আইনের মামলায় শুনেছেন ১৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ। জোট সরকারের ক্ষমতাধর এই প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও সাত মামলার বিচারকাজ চলমান।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলাটির রায় ঘোষণার আগের ধাপ যুক্তিতর্কের পর্যায়ে রয়েছে। বসুন্ধরা গ্রুপের আইটি বিশেষজ্ঞ সাব্বির আহমেদ হত্যা মামলার আসামিদের বাঁচাতে ২১ কোটি টাকার ঘুষ নেওয়ার মামলাটি রয়েছে চার্জগঠনের পর্যায়ে এবং আয়কর ফাঁকির মামলাটিতে চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ। এর বাইরে সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় দুই মামলা এবং আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আরও দুই মামলাও সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
মামলাগুলো সম্পর্কে বাবরের আইনজীবী পারভেজ হোসেন বলেন, ‘ওনার (বাবর) বিরুদ্ধে সব মামলাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে হওয়া অধিকাংশ মামলায় দেখবেনÑ প্রথম ও দ্বিতীয় দফা তদন্তেও তার নাম আসেনি। পরে শুধু রাজনৈতিক কারণে তাকে যুক্ত করা হয়েছে। তিনি ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য মামলাগুলোয় আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এবং চালিয়ে যাবেন।’
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ২০০১ সালে সরকার গঠনের পর যে কয়েকজন ব্যক্তি প্রবল ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাবর। মনে করা হয়, ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই ছিল বাবরের ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার মূল ভিত্তি। তিনি ছিলেন স্বরাষ্ট্রর মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী, যেখানে পূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরী। যদিও ক্ষমতা প্রয়োগের মানদণ্ডে বাবর ছাপিয়ে যান তার পূর্ণ মন্ত্রীকেই। একটা সময় আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পর প্রতিমন্ত্রী বাবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেকটা একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি হয়ে যান।
১৯৫৮ সালের ১০ অক্টোবর জন্ম নেওয়া লুৎফুজ্জামান বাবরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এইচএসসি পর্যন্ত। ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো নেত্রকোনা-৪ (মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরী) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনেও তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই আসন থেকে জয় পান ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও।
গ্রেপ্তার ও অস্ত্র মামলায় দণ্ড
২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই বছর ২৮ মে যৌথবাহিনী বাবরকে গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। সেই সঙ্গে তার বাসার শোয়ার ঘর থেকে একটি অবৈধ রিভলবার ও ২৫ রাউন্ড গুলি উদ্ধারের ঘটনায় গুলশান থানায় মামলা হয়। একই বছর ২৩ জুন পুলিশ বাবরকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দিলে তা গঠন হয় ২৫ জুলাই। সাবেক এই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে ২০০৭ সালের ৩০ অক্টোবর অবৈধ অস্ত্রের জন্য ১০ বছর এবং গুলি রাখার জন্য ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকা মহানগরের ৯ নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।
জামিনে মুক্তি এবং পুনরায় কারাগারে
অস্ত্র মামলায় ১৭ বছর কারাদণ্ড হওয়ার পরও উচ্চ আদালতে আপিল করে ২০০৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বাবর জামিনে মুক্ত হন। পরে আপিল বিভাগ তাকে নিম্নআদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে ২০০৯ সালের ৫ মার্চ ঢাকা সিএমএম আদালতে নিজেকে সমর্পণ করে জামিন চান। যদিও আদালত তার জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। এর পর থেকে তিনি গত এক যুগ ধরে কারাগারেই রয়েছেন।
দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাটে ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান আটক হয়। এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র আইনে ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলা হয়। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি অস্ত্র মামলায় চট্টগ্রামের এক নম্বর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল বাবরসহ ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন। মামলাটিতে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য পেপার বুক প্রস্তুত হলেও এখনো শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ হয়নি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গ্রেনেড হামলার দুই মামলায় বিচার শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বাবরসহ ১৯ জনের ডবল মৃত্যুদণ্ড এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। এ ছাড়া রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের ট্রিপল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডেরও আদেশ দেওয়া হয়। মামলা দুটিতে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য পেপার বুক প্রস্তুত হলেও এখনো বেঞ্চ নির্ধারণ হয়নি শুনানির জন্য।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা
৭ কোটি ৫ লাখ ৯১ হাজার ৮৯৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৮ সালের ১৩ জানুয়ারি বাবরের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করে দুদক। তদন্ত শেষে ওই বছরই চার্জশিট দাখিল করা হয়। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার ৭ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে যুক্তিতর্কের শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।
আয়কর ফাঁকির মামলা
৮ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার ১২২ টাকার সম্পদের ওপর প্রযোজ্য আয়কর ফাঁকির অভিযোগে ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এনবিআর বাবরের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করে। এ মামলায় ২০১৪ সালের ৬ আগস্ট ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ চার্জগঠন করেন। সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে যদিও উচ্চ আদালতের আদেশে মামলাটি স্থগিত হয়। বর্তমানে মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা মামলা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজারে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, তার ভাতিজা শাহ মঞ্জুর হুদাসহ পাঁচজন। আহত হন ৭০ জন। এ ঘটনায় হবিগঞ্জ সদর থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় ১০ জনকে আসামি করা হয়। পরে ২০১১ সালে অধিকতর তদন্তে আরও ২৬ জনকে আসামি করা হয়। পরে তৃতীয় দফায় তদন্তে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি নেতা হারিছ চৌধুরী, মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জের সাবেক মেয়র জিকে গউছসহ প্রায় ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। মামলা দুটিও বর্তমানে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।
সূত্র- আমাদের সময়