ঢাকায় একটি জটই প্রতিদিন জটলা পাকায় তা হলো যানজট। এ জটে জান ছটফট করলেও ঝট করে জট খুলবে না তা অপ্রিয় সত্য। এদিকে কিছু মানুষ দুই হাতে টাকা কামাচ্ছে আর নতুন গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছে। ফলে দিনদিন যানজট বাড়ছে আর জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে।
যানজটের কারণে লোকসান আর ভোগান্তির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঠিক কতটা আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, কতটা কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, মানুষ কতটা ভোগান্তির সম্মুখীন হচ্ছে, এর সমাধানের নানা রকম উপায় নিয়ে গবেষণা হলেও কোথাও সফলতা আছে কি?
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে যানবাহন ব্যবস্থাপনা, অফিস ও স্কুল সময়সূচি, অনিয়ন্ত্রিত অবৈধ পার্কিং, ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যাধিক্য, লাইসেন্সবিহীন চালক, রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ ও অন্যান্যদের চাঁদাবাজি,পার্কিংয়ের অপ্রতুলতা, শহরের মধ্যে রেল ক্রসিং, ভিআইপি মুভমেন্ট, মাত্রাতিরিক্ত রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা ও বাস ট্রাকের অবৈধ স্ট্যান্ড, ফুটপাত অবৈধ দখল করে হাটবাজার ও দোকানপাট নির্মাণ, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থায় খানাখন্দে ভরা ভাঙাচোরা ও অপ্রতুল রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা, মাত্র ১৫% যাত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ির প্রায় ৭০% সড়ক দখল, মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব, ফুটওভার ব্রিজ, ফুটপাত ও রাস্তা ব্যবহারে আমাদের অসচেতনতা ও জনগণের আইন না মানার স্বভাব সবকিছু মিলিয়েই এ যানজট, দুর্ভোগ।
আরোও পড়ুন…তিন পেরিয়ে উদ্যোক্তা ইরার কাঠপোকা
যানজটে রাজধানী এখন মুমূর্ষু। সড়ক ব্যবস্থাপনাই যেন কোমায় চলে গেছে। লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কোন রকমে বাঁচিয়ে রাখা হলেও এর থেকে চিরস্থায়ী পরিত্রাণের উপায় কী?
যানজট এখন শুধু রাজধানীর নয়, দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে দেওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট । যানজটের কারণে যে সময় নষ্ট হয় তার ক্ষয়ক্ষতি অপূরনীয়, অর্থনীতির ভাষায় তা বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। অন্য দিকে উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের অভাবে রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণের নামে সারা বছর খোঁড়াখুঁড়িতে নির্মাণসামগ্রী রাস্তার ফেলে রাখায় যানজটে মানুষের চরম দুর্ভোগের হিসাব রাখে কে?
যানজটের কারণে ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’ প্রবাদ বাক্য ব্যঙ্গ করে বলতে শুনা যায়- এতো বেশি লেখাপড়া করায় এখন সারাদিন গাড়ি ঘোড়ায় অর্থাৎ যানজটে কাটে। যানজটের কারণে অফিস সময়ে গণপরিবহণে চলাচলকারী যাত্রীদের প্রায় সময় গন্তব্যে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় কর্মক্ষেত্রে জবাবদিহি করতে হয়।
ঢাকায় প্রায় ৮০% মানুষের নিত্য গন্তব্যের দূরত্ব ১- ৫ কি.মি এর মধ্যে হলেও হাঁটা ও গণপরিবহনকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িকে উৎসাহিত করলে যানজট ছাড়াও জ্বালানি অপচয় ও দূষণ বাড়বে । যানজটে সবার একটাই প্রশ্ন এই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ লাগবে ইঁদুরের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?
বাঁশবাগান না থাকলেও ঢাকায় বাসবাগান আছে। যানজটের জটিলতার জটলায় জট পাকিয়ে থাকা বাস, কার, সিএনজি তে দীর্ঘ সময়ে বসে থাকতে থাকতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন, কেউ ঘুমিয়ে যান, কারও পায়ে পানি এসে যায়, কেউ এর কোনো সমাধান না পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আর কেউবা বিরক্ত হয়ে হেঁটেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন। শুধু তাই না ‘এখানে বাস থামানো নিষেধ ’ লেখার জায়গায় কেন জানি ড্রাইভাররা ইচ্ছে করেই স্টপেজ বানায়, গাড়ি থামায়, যাত্রী ওঠায় এবং নামায়। কী লেখা আছে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, উদ্দেশ্য টাকা কামানো। এরপর বর্ষায় রাস্তাঘাটের সমন্বয়হীন খোঁড়াখুঁড়িতে রাস্তা ডুবছে, জলজটে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে ও যানজটে নাভিশ্বাস উঠছে।
সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিসগুলো ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ একি সময়ে হওয়ায় গন্তব্যের মিছিলে যানবাহনে বসে যাওয়া তো দূরের কথা দাঁড়ানোর জায়গাও পাওয়া যায় না। দেশের রাস্তাঘাট, ভবন নির্মাণ সবকিছুই কেমন যেন অপরিকল্পিত। রাজধানীর যানজট সমস্যাটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। সমন্বয়হীনতার অভাবে এখানে যা-ই প্রয়োগ করা হোক না কেন তা কোনো কাজে না এসে উল্টো আরও নানা সংকট সৃষ্টি করে ।
আয়তনে ২৫ শতাংশের স্থলে ঢাকায় মোট রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৮ শতাংশ দিয়েও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় যানজট নিরসন অসম্ভব নয়। ঢাকার চেয়ে বেশি যানজটের শহর কলকাতা পরিকল্পিত নগরায়নে লন্ডন-সিঙ্গাপুরের সমপর্যায়ে পৌছে গেছে । তাই ঢাকায় সিটি কর্পোরেশন , রাজউক, ওয়াসা, ওয়াপদা, ডেসকোসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে সমন্বয় করেই নগর উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে যানজটের যবনিকাপাত ঘটানোই হোক একমাত্র লক্ষ্য। এটা এখন সময়ের দাবি, সবার দাবি। কারণ, এখন চারদিকে একটিই আওয়াজ- ‘যানজটে জলজটে জান যায়’।
সড়কপথের পাশাপাশি চক্রাকার বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকলে শহরের উপর চাপ কমে। ঢাকায় এ রকম ব্যবস্থা গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এখনো তা গড়ে ওঠেনি। ফলে সড়কের ওপর চাপ বেড়েছে, যার মূল্য দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। তাই ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে নগর পরিবহনের মত অধিক পরিমাণে একীভূত আধুনিক দোতলা বাস নামানো, রিকশা ও প্রাইভেট কারের লাগাম টানা, ট্রাক ও ঠেলাগাড়ি কেবল রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত চলাচলের অনুমতি দেওয়া, বর্ধিত ঢাকার সঙ্গে মূল ঢাকায় চলাচলের জন্য অধিক সংখ্যক বাইপাস সড়ক নির্মান, রাস্তাগুলো দখলমুক্ত করা, রাস্তায় অপরিকল্পিত খোঁড়াখুড়ি বন্ধ করা, আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল মহাখালী, সায়দাবাদ ও গাবতলী থেকে ঢাকার বাইরের দ্রুত স্থানান্তর, রাস্তায় ভিআইপিদের ট্রাফিক নিয়ম মানতে বাধ্য করা, যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজার আড়ৎ ঢাকার বাইরে স্থানান্তর, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, ট্রাফিক পুলিশকে প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক করাই হোক যানজট থেকে উত্তোরণের শপথ।
আরোও পড়ুন…ভালো কাজের হোটেল’
অবকাঠামোর উন্নয়ন আর আইনের কথা যতই বলা হোক না কেন, ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি সমন্বিত পরিকল্পনাই পারে ৪০০ বছরের পুরনো রাজধানী ঢাকাকে বসবাস উপযোগিতা করতে। তাই নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই সরকার, বিরোধী দল, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদ, সুশীল সমাজ, ট্রাফিক পুলিশ ও আমজনতা সবার প্রতিজ্ঞা হোক নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে এসে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বসবাস উপযোগী আধুনিক ঢাকা গড়তে ভয়াবহ যানজট সমস্যার এখনই যবনিকাপাত ঘটানো।
লেখক ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
গবেষক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী
fokoruddincse@gmail.com
ইবাংলা/আরএস/১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২