জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুর মৃত্যুতে ঘোষিত তিন দিনের শোক শেষ হওয়ার আগেই জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব পদ নিয়ে শুরু হয়েছে টানাহ্যাঁচড়া। জ্যেষ্ঠ নেতারা বৈঠক করে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, নবীন কোনো নেতাকে মহাসচিব নিয়োগ করলে তারা মেনে নেবেন না। জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাউকে বা কো-চেয়ারম্যানদের মধ্যে একজনকে মহাসচিব করতে হবে।
জি এম কাদের বলেছেন, কাকে মহাসচিব নিয়োগ করবেন, তা এখনও ঠিক করেননি। যারা বৈঠক করেছেন, তাদের কয়েকজন দলের কো-চেয়ারম্যান। তাদের পদমর্যাদা মহাসচিবের ওপরে। তারা কেন নিচের পদে আসতে এত অস্থির?
করোনা-পরবর্তী জটিলতায় গত শনিবার সকালে মারা গেছেন জাপা মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই জাপার অতিরিক্ত মহাসচিব গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হতে চেষ্টা করেছিলেন বলে জাপা সূত্র জানিয়েছে। এ চেষ্টাও সিনিয়র নেতাদের আপত্তিতে টেকেনি।
জি এম কাদের বলেছেন, শামীম বয়সে তরুণ, শিক্ষিত। বক্তৃতা ভালো করে। তাই চিন্তাভাবনা করেছিলেন, তাকে মহাসচিব নিয়োগ করা যায় কিনা। কিন্তু সিদ্ধান্ত না হতেই জ্যেষ্ঠ নেতারা যেভাবে বৈঠক করলেন, তা শোভনীয় হলো না। যারা বৈঠক করে দাবি তুলেছেন, তাদের মধ্য থেকে কাউকে মহাসচিব করতে হবে, তাদের প্রত্যেকেই কিন্তু পৃথকভাবে এ পদ পেতে চেষ্টা করছেন।
জি এম কাদেরের উত্তরার বাসায় গিয়েছেন শামীম পাটোয়ারী। তাকে মহাসচিব পদে নিয়োগ দিয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করা হতে পারে- এমন খবরে জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ এমপির কলাবাগানের অফিসে গতকাল সোমবার একত্র হন জ্যেষ্ঠ নেতারা। এ বৈঠকে ছিলেন জাপার কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, মজিবুল হক চুন্নু এমপি, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, সাবেক মহাসচিব তথা বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান ও লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি। বিদেশে অবস্থান করলেও গতকালের বৈঠকে টেলিফোনে যুক্ত হন জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। ৭ অক্টোবর তিনি দেশে ফেরার পর মহাসচিব পদে কে আসবেন, তা চূড়ান্ত হবে বলে জাপার সূত্র জানিয়েছে।
বৈঠক থেকে উপস্থিত নেতাদের পক্ষে মজিবুল হক চুন্নু টেলিফোনে জি এম কাদেরকে বলেন, সারাদেশের নেতাকর্মীদের কেউ অল্প ক’দিন আগে দলে আসা কাউকে মহাসচিব পদে মানবে না। তিনি যদি জ্যেষ্ঠ নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে কাউকে মহাসচিব নিয়োগ করেন, তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য চেয়ারম্যান হিসেবে জি এম কাদেরকেই দায়ী থাকতে হবে।
জি এম কাদের বলেছেন, বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতাসহ সবাই মিলে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে নেতৃত্ব ও দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি যতদিন নেতৃত্বে আছেন, সবাইকে শৃঙ্খলা মানতে হবে। গত নির্বাচনের আগে বহুল প্রচারিত অভিযোগ ছিল, জাপায় মনোনয়ন ও পদবাণিজ্য হয়েছে। তাই স্বচ্ছ ভাবমূর্তির একজনকে মহাসচিব করতে চাইছি। বিশেষ করে একজন তরুণকে এ পদে ভাবছি। জাপার প্রতি তরুণ প্রজন্মের সমর্থন অন্য দলের তুলনায় কম।
মহাসচিব হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন আগে দুই দফায় ১৬ বছর দায়িত্ব পালন করা রুহুল আমিন হাওলাদার ও মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ। এ পদ পাওয়ার চেষ্টা করছেন বাকি তিন কো-চেয়ারম্যানও। তবে তারা সবাই একাট্টা হয়েছেন ৪১ বছর বয়সী শামীম পাটোয়ারীকে ঠেকাতে।
কাজী ফিরোজ কলাবাগানের বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সিনিয়র নেতারা ছাড়া আরও অনেকে বৈঠকে ছিলেন। সবাই একমত হয়েছেন, জ্যেষ্ঠ নেতাদের কাউকে মহাসচিব করতে হবে। এমন কাউকে মহাসচিব করা যাবে না, যিনি মাত্র সাত-আট বছর আগে রাজনীতিতে এসেছেন। সিনিয়র যাকেই মহাসচিব করা হবে, তাকে মেনে নেওয়া হবে।
ফিরোজ রশীদ বলেন, তারা জানতে পেরেছেন, মহাসচিব পদে শামীম পাটোয়ারীকে নিয়োগ করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করা হতে পারে। জ্যেষ্ঠ নেতারা চান, সবার সঙ্গে আলোচনা করে জি এম কাদের তাদের মধ্য থেকে কাউকে মহাসচিব নিয়োগ করুন। যিনি মৃত্যুশয্যায় থাকা মহাসচিবকে সরিয়ে ভারপ্রাপ্ত হতে চেয়েছিলেন, এমন স্বার্থপর মানসিকতার কাউকে নেতা বানালে দল বিলীন হয়ে যাবে। জিয়াউদ্দিন বাবলুর জন্য ঘোষিত শোক কর্মসূচি এখনও শেষ হয়নি। এর মধ্যেই যিনি পদ দখলের চেষ্টা করছেন, তিনি যে দলের জন্য ভালো হবেন না- জি এম কাদেরকে সে বার্তাই দেওয়া হয়েছে বৈঠক থেকে।
মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ গত বছর জুলাইয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুর কাছে মহাসচিব পদ হারান। একাদশ সংসদ নির্বাচনের দিন পঁচিশ আগে রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে তাকে মহাসচিব করেছিলেন জাপার প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জি এম কাদের চেয়ারম্যান হওয়ার সাত মাসের মধ্যে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে সরিয়ে দেন। তিনি বলেছেন, যাকে মহাসচিব করা হবে বলে গুঞ্জন রয়েছে, তাকে রংপুরের কেউ মানবে না। অবাঞ্ছিত ঘোষণা করবে।
তবে আরও স্পষ্ট করে মতামত দিয়েছেন লিয়াকত হোসেন খোকা। তিনি বলেছেন, জাপার জন্য, এরশাদের জন্য জেল খেটেছেন। অথচ দু’দিন হয় দলে এসেছেন এমন কেউ মহাসচিব হয়ে যাবেন, তা মানা হবে না। শামীমের দলে কোনো অবদান নেই। দলের জন্য যাদের ত্যাগ আছে, তাদের মধ্য থেকে কাউকে বানালে আপত্তি নেই। কিন্তু নব্য নেতাদের মাথার ওপর বসানো যাবে না।
পাঁচবারের এমপি মজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্যও অভিন্ন। তিনি বলেছেন, বছর দুই বাদে নির্বাচন। এমন কাউকে মহাসচিব করতে হবে, যার শুধু দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ নয়, জাতীয়ভাবেও পরিচিতি রয়েছে; যিনি জোট শরিকদের সঙ্গে সমঝোতা ও আলোচনা করে জাপার স্বার্থ রক্ষা করতে পারবেন।
বৈঠকে অংশ নিলেও সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন রুহুল আমিন হাওলাদার। তিনি বলেছেন, এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার নেতাকর্মীরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। জিয়াউদ্দিন বাবলু প্রবীণ ও দলের নেতা ছিলেন। যারা সব লোভ-লালসা উপেক্ষা করে, প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে জাপায় রয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে একজন মহাসচিব করাই দলের জন্য মঙ্গলজনক। সারাদেশের নেতাকর্মীরা টেলিফোনে সিনিয়রদের এ কথা বলেছেন।
শামীম পাটোয়ারীর বক্তব্য জানতে না পেরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার সব ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। কার্যালয়ে ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
কো-চেয়ারম্যানদের পদাবনতি নিয়ে মহাসচিব হওয়া ঠিক নয় বলে জি এম কাদের মন্তব্য করলেও এ পদে আসতে আগ্রহী নেতারা বলছেন, জিয়াউদ্দিন বাবলুও কো-চেয়ারম্যান থেকে মহাসচিব হয়েছিলেন। জাপা চেয়ারম্যান বলেছেন, জিয়াউদ্দিন বাবলু দলকে ২৪ ঘণ্টা সময় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মহাসচিব হয়েছিলেন। এখন যারা এ পদে আসতে চাইছেন, তারা কি সময় দিতে পারবেন?