রাজধানীর রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমান ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় রবার বাগানসহ অন্তত সাত হাজার একর জমি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এ জমির সিংহভাগই জবরদখল করা। আর জবরদখলের কাজে পীর ও তার অনুসারীদের প্রধান হাতিয়ার হলো মিথ্যা মামলা। যারা জমি লিখে দিতে অস্বীকৃতি জানান, তাদের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক মিথ্যা মামলা দিতে থাকেন পীর ও তার অনুসারীরা। ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির নামে ৪৯টি মামলাও দিয়েছে এ সিন্ডিকেট।
দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে জমি জবরদখলের অভিযোগ নতুন করে সামনে আসে আট ভুক্তভোগীর করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সবুজবাগের আবদুল কাদের, সাভারের মাহবুবুর রহমান ও নাজমা আক্তার, নরসিংদীর জয়নাল আবেদীন ও আইয়ুব, কক্সবাজারের রামু থানার আলাউদ্দিন, কুতুবদিয়ার জিন্নাত আলী এবং খুলনার নার্গিস আক্তার এ রিট করেন। তাতে বলা হয়, পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা হয়রানির উদ্দেশ্যে দেশব্যাপী একাধিক মিথ্যা মামলা করেছে। এসব মিথ্যা মামলায় কয়েকজন কারাগারে রয়েছে। শুধু সম্পদ লিখে না দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এসব মামলা হয়েছে।
রিট আবেদনটির প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের দেওয়া এ সংক্রান্ত আদেশের লিখিত অনুলিপি প্রকাশিত হয় গত সোমবার।
তাতে দুদকের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছেন, দিল্লুর রহমান ও তার প্রতিষ্ঠানের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সম্পত্তি রয়েছে, সেগুলোর উৎস সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে আদালতকে জানাতে হবে। এ ছাড়া পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে খোঁজ নিতে হবে, পীর ও তার পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত উলামা আঞ্জুমান বাইয়্যিনাতের মতো প্রতিষ্ঠানের আড়ালে জঙ্গি সংগঠন আছে কিনা। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দুদক ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে হবে। পাশাপাশি রিট আবেদনকারী আটজনের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিবেচনায় নিতে বলা হয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাত দফা সুপারিশও।
২০১৮ সালে পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পায় মানবাধিকার কমিশন। তদন্তে নেমে কমিশন অভিযোগের সত্যতা পায়। সাধারণ মানুষকে যেন ধর্মের নামে ধোঁকা দিতে না পারে সে জন্য সাত দফা সুপারিশ করে কমিশন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- কথিত পীর দিল্লুর রহমান ও তার প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে যেসব সম্পদ রয়েছে তার তালিকা প্রস্তুত করে আয়ের উৎস ও রাজস্ব প্রদানের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। সাধারণ মানুষকে যেন ধর্মের নামে ধোঁকা দিতে না পারে এবং নিরীহ মানুষের সম্পদ যেন হয়রানিমূলকভাবে মিথ্যা মামলা দিয়ে হাতিয়ে নিতে না পারে, তার উদ্যোগ নেওয়া। পীর দিল্লুর রহমানের মূল আস্তানাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শাখা কার্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া। তার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক কালো তালিকাভুক্ত জঙ্গি সংগঠন ‘উলামা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনাত’ এবং তার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রচারিত সংবাদপত্র ‘আল বাইয়্যিনাত ও আল ইহসান’ নিষিদ্ধের সুপারিশও করে মানবাধিকার কমিশন।
এর আগে পীর সিন্ডিকেটের মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পেতে হাইকোর্টের দারস্থ হন রাজধানীর শান্তিবাগের বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চন। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৪৯টি মামলা দেওয়া হয় তার নামে। এ বিষয়ে হাইকোর্টে রিট করেন একরামুল। এর পর অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি)। সিআইডির তদন্তে বেরিয়ে আসে কথিত এ ‘ধর্ম ব্যবসায়ীর’ আসল রূপ।
আদালতে দাখিল করা সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একরামুল আহসানের তিন ভাই ও এক বোন। ১৯৯৫ সালে তার বাবা আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনে ৩ শতাংশ জমির ওপর তিনতলা পৈতৃক বাড়ি তাদের। বাবার মৃত্যুর পর একরামুলের বড় ভাই আক্তার-ই-কামাল, মা কোমার নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু একরামুল ও তার আরেক ভাই কামরুল আহসানকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেও ওই পীরের মুরিদ করা যায়নি। এর মধ্যে একরামুল আহসানের মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক জমির অধিকাংশই পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আর একরামুল ও তার ভাইয়ের অংশটুকু দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করতে পীর দিল্লুর ও তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। এ নিয়ে পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের সঙ্গে একরামুলের শত্রুতা তৈরি হয়। ওই শত্রুতার কারণেই একরামুলের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হয়রানিমূলক মামলা করেন পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা।
মামলার নথি পর্যালোচনার ভিত্তিতে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুলের বিরুদ্ধে মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরকদ্রব্য আইন, হত্যাচেষ্টা, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ নানা অভিযোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় মামলা করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বাদী, সাক্ষী কিংবা ভুক্তভোগীর কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ এবং ওই দরবার শরিফের পীরের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে। এসব মামলা দায়েরের পেছনে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমান এবং তার অনুসারীদের স্বার্থ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, একরামুলের বিরুদ্ধে মোট ৪৯টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে জিআর মামলা ২৩টি ও সিআর মামলা ২৬টি। এরই মধ্যে ১৫টি জিআর ও ২০টি সিআর মামলায় একরামুল আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা বিচারাধীন। প্রতিবেদনে বলা হয়, রিট পিটিশনে পক্ষভুক্ত ২০ জন আদালতে বাদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা করেছেন। এদের বাইরে আরও একাধিক ব্যক্তির তথ্য পাওয়া গেছে, যারা একরামুলের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক একাধিক মামলার বাদী ও সাক্ষীর ভূমিকা পালন করেছেন।
এ প্রতিবেদন দেখার পর হাইকোর্ট বলেন, ‘একটা পীরের সিন্ডিকেট ধর্মের দোহাই দিয়ে কীভাবে নিরীহ মানুষকে হয়রানি করছে!’
গত মাসে যে আটজন রিট করেছেন, তাদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আছেন মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি জানান, ১৯ সেপ্টেম্বর দেওয়া মৌখিক আদেশের লিখিত অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা সেই আদেশের সার্টিফায়েড কপি হাতে পেয়েছি। আদালত এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ৫ ডিসেম্বর দিন ধার্য রেখেছেন।
সূত্র-আমাদের সময়