খুলনার কয়রা উপজেলার গোবরা দাখিল মাদ্ররাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ইতি আক্তার (১৪)। মাদ্ররাসায় ছুটির দিনে এক বিকালে জানতে পারে সন্ধ্যায় তার বিয়ে।ইতি আক্তার কে নিয়ে যাওয়া হয় পাশ্ববর্তী প্রতাপনগর ইউনিয়নে তার নানা বাড়িতে।সন্ধ্যায় গোপনে তার বিয়ে হয়ে যায়।বাল্যবিয়ের শিকার ইতি আক্তারের সংসার বেশিদিন টিকেনি,তিন মাস পরেই তার ডিভোর্স হয়ে যায়।সে ফিরে আসে তার বাবার বাড়িতে, আবার মাদ্ররাসায় যাওয়া শুরু করে।
আরও পড়ুন…ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কর্মসূচীর শুভ উদ্বোধন
ইতি আক্তারের মত কয়রার স্থানীয় একটি মাদ্ররাসার ছাত্রী রুবাইয়া আক্তার (১৩)। সুন্দরবন কুলঘেষা কয়রার মঠবাড়ি গ্রামে বাড়ি। তাঁর অমতে জোর করে বিয়ে দেওয়া ২৭ বছরের এক যুবকের সাথে,কিছুদিনের মধ্যে তাঁর সংসার ভেঙে যায়।
ইতি ও রুবাইয়ার মত কয়রার শতশত স্কুল ছাত্রী এখন গৃহিণী। স্বামী, সন্তান নিয়ে এখন সফল মায়ের দায়িত্ব পালন করছে।বাল্য বিয়ের শিকার হওয়া এসকল কিশোরী মধ্যে অনেকের ডিভোর্স হয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসছে।
সুন্দরবনের কুলঘেষা বারবার প্রাকৃতিক দুযোর্গে ক্ষতিগ্রস্ত কয়রা উপজেলার মানুষের অভাব অনাটন নিত্যদিনের সঙ্গী।পড়ালেখা শিখিয়ে মেয়েদের বড় করার ইচ্ছে থাকলেও অনেক পিতা মাতা তাদের কিশোরী কন্যা কে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচেন।এলাকায় বখাটেদের উৎপাত, উত্ত্যক্ত করা, অপরহরণচেষ্টা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অ্যাসিড নিক্ষেপের আতঙ্কে তারা তাদের মেয়েকে বয়স পূর্ণ না হতেই বাল্য বিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
কয়রা উপজেলার সদরে অবস্থিত সুন্দরবন বালিকা বিদ্যালয়ে করোনাকালীন সময়ে ৩১ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যায়।এছাড়া কালনা দাখিল মাদ্ররাসার ৫২ জন,সুন্দরবন সিদ্দিকী দাখিল মাদ্ররাসা ৩৭,কয়রা মদিনাবাদ দারুচ্ছলাম মহিলা মাদ্ররাসার ৫০ জন,দক্ষিণ মহেশ্বরীপুর দাখিল মাদ্ররাসা ৩০ জন,কুশোডাঙা আলিম মাদ্ররাসার ৩০ জন সহ উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের ৮৮৬১ জন ছাত্রীর মধ্যে ৬৮১ জনের বিয়ে হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি।বিশেষ করে উপজেলার দাখিল মাদ্ররাসা গুলোর বাল্য বিয়ের হার অনেক বেশি।করোনার বন্ধের পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরে এই সকল মাদ্ররাসা ও বিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে ।
আরও পড়ুন…সমুদ্রে নেমে নিখোঁজ, ৮ ঘণ্টা পর মিললো মাদরাসাছাত্রের মরদেহ
সুন্দরবন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খায়রুল আলম জানান করোনাকালীন সময়ে তাঁর বিদ্যালয়ের ৩১ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে যায়।তিনি বলেন,বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে প্রতিনিয়ত ছাত্রীদের সচেতন করার জন্য আমরা অনেক প্রচার প্রচারণা চালিয়েছি যার ফলে বাল্যবিয়ের হার অনেক কমে গেছে।এলাকার মানুষের মধ্যে শিক্ষার অভাব ও অভাব অনাটন থাকায় এ এলাকার মানুষ কিশোরীদের দ্রুত বিয়ে দিয়ে দেয়।আমরা উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাল্য বিয়ে বন্ধের জন্য অনেক ক্যাম্পাইন ও প্রচারণা চালিয়েছি যার কারণে বাল্যবিয়ে কমে গেছে।
কয়রা উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার পরে বিদ্যালয় খোঁলার পরে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণিপড়ুয়া অনেক ছাত্রীরই বিয়ে হয়ে গেছে।তাদের অনেকে এখন বিদ্যালয়ে আসে না।পড়াশুনা থেকে দূরে আছে। বিশেষ করে বিয়ের পরে এই সকল কিশোরীদের শ্বশুর বাড়ির লোকজন পড়াতে চায় না বিধায় তারা আর পড়তে পারে না।
কয়রা উপজেলা সদর থেকে দূরের ইউনিয়নে অবস্থিত বিদ্যালয়ে বাল্যবিয়ের হার অনেক বেশি। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ে কাজ করা একটি উন্নয়ন সংস্থার মাঠকর্মী মল্লিকা মৃধা বলেন,ইউনিয়নে প্রতিসপ্তাহে কিশোরীদের বিয়ে হয়। অভিভাবকদের বুঝালেও তারা বোঝের চেষ্টা করে না। ভাল পাত্র পেলে চুরি করে গ্রাম থেকে অন্যত্র গিয়ে কিশোরীদের বিয়ে দিয়ে থাকে।একবার বিয়ে হয়ে গেলে তখন আর কিছু করার থাকে না।
কয়রা সদর ইউনিয়নে গোবরা গুচ্ছ গ্রামে ১১ বছরের পরে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়।কিশোরী বয়সে অধিকাংশ মা হয়ে যায়।তেমনি গুচ্ছ গ্রামে ১২২ নং ঘরে বাসিন্দা তাজরিয়া খাতুন। প্রতাপস্মরণী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬ষ্ট শ্রেণিতে থাকতে একজন ভ্যানচালকের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। তিনি ১ সন্তানের জননী। গোবরা গুচ্ছ গ্রাম সহ উপজেলায় অবস্থিত অন্য সব গুচ্ছ গ্রামে কিশোরীদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায় বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন…পার্লার সেবার নামে ডেকে অন্তঃসত্ত্বাকে ধর্ষণ: দুই শিক্ষার্থী রিমান্ডে
কয়রা সদরে গোবরা গুচ্ছ গ্রামের বাসিন্দা সেলিনা খাতুন বলেন,আমরা গরিব মানুষ। মেয়েকে বেশিদূর তো পড়ালেখা করাতে পারব না। ভালো পাত্র পেয়েছি বলেই দেরি না করে বিয়ে দিয়েছি,৭ম শ্রেণিতে থাকতে মেয়ে কে বিয়ে দিয়েছি,স্বামী সন্তান নিয়ে মেয়ে ভাল আছে।
কয়রা উপজেলা প্রাথমিক সহকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও উত্তর মদিনাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আলমগীর হোসেন জানান ,করোনার বন্ধ সময়ে উপজেলায় অনেক বালিকার বিয়ে হয়েছে।তিনি বলেন তাঁর বিদ্যালয়ে ৩ জনের বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির একজন ছাত্রী রয়েছে। এলাকায় অল্প বয়সে কিশোরীদের বিয়ে হয় বলে তিনি জানান।অভিভাবকদের সচেতন করার পরেও অনেকে চুরি করে কিশোরীদের বিয়ে দিয়ে দেন বলে তিনি অভিযোগ কনেন।
দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়ন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারমান ও ৪নং ওয়ার্ড সদস্য মো.আব্দুস সালাম বলেন,৪নং ওয়ার্ডে অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় ঘর সংসার করতে না পরে চার জন কিশোরী ডিভোর্স নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে আসছে।তিনি বলেন,ইউনিয়ন পরিষদ সচেতনতার কর্মসূচি ফলে বাল্যবিয়ের হার আগের থেকে অনেক কমে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়রা সদর ইউনিয়নের একজন বিবাহ রেজিস্টার (কাজী) বলেন, বর্তমানে আইনসংগত উপায়ে বাল্য বিয়ের নিবন্ধন হয় না। কিছু অসাধু রেজিস্টার নকল নিবন্ধন ফরমে সই নিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করছে। পরবর্তীতে যখন ছাত্রীদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে তখন রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। ফলে আইন করেও কৌশলের কারণে বাল্য বিয়ে বন্ধ করা যাচ্ছে না।
আরও পড়ুন…চালকদের নিয়মিত চোখ পরীক্ষা করলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে
কয়রা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো.বাকী বিল্লাহ বলেন,বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য অনেক প্রচার প্রচারণা চালানোর ফলে বাল্যবিয়ে কমে গেছে।তারপর কিছু শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা চুরি করে নোটারী পাবলিক মাধ্যমে এফিডেভিট করিয়ে বয়স বাড়িয়ে বিয়ে দিয়ে দিয়ে থাকে।বিষয় গুলো আমরা জানতে পারলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি কিন্তু গোপনে এগুলো হওয়ায় আমাদের কাছে খবর আসে না।
ইবাংলা/জেএন/১৪ অক্টোবর ২০২২