সম্ভাবনার আঠারোতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

ইবাংলা ডেস্ক

জগাবাবুর পাঠশালা থেকে পর্যাক্রমে ব্রাহ্ম স্কুল, কলেজ ও সর্বশেষ পূর্নাঙ্গ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে শতাব্দীর হাজারো ইতিহাস। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর সংকট ও সাফল্যে ১৮তম বর্ষে আজ পদার্পণ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কণ্টকাকীর্ণ পথের দীর্ঘ যাত্রায় সাক্ষী হয়েছে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার, নিজেও হয়েছে ইতিহাসের অংশ। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা দেড়শ’ বছরের বেশি প্রাচীন এ বিদ্যাপীঠ অতীতকাল থেকেই বাঙালির ইতিহাস – ঐতিহ্য, সংহতি, আন্দোলন – সংগ্রাম, শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে আলোর দূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।

আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস ২০ অক্টোবর । বিভিন্ন সময় হলের দাবিতে আন্দোলনের ফলস্বরূপ ২০১৪ সালে একমাত্র বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ছাত্রী হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে অবশেষে ২০২০ সালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে উদ্বোধন হয়। ‘ সকাল ৮ টায় কিছু লালচে দোতলা বাসে ঝুলন্ত হাজারো ছাত্র। একে অন্যের হস্ত ধরে শিকল করে হই হই সই সই উচ্চ আওয়াজ তুলে, ফতুল্লা কিংবা উত্তরা থেকে ঝুলতে ঝুলতে পাড়ি দেয় জগন্নাথের কোলে’। শিক্ষার্থীদের এমন হাজারো গল্পের প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায় প্রায় ২০০ একর জমির ওপর স্থানান্তরের লক্ষ্যে প্রায় ২০০০ হাজার কোটি টাকার আধুনিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প একনেকে পাস হয়।

এই প্রকল্পের পর কর্তৃপক্ষ নতুন ক্যাম্পাসে সব সংকটের যবনিকাপাত ঘটবে বলে আশ্বাস দিলেও সেই আলাদিনের চেরাগের স্বপ্ন দেখতে দেখতেই স্নাতক শেষ হয়েছে হাজারো শিক্ষার্থীর। ২০২০ সালের অক্টোবরের মধ্যে নতুন ক্যাম্পাসের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভূমি অধিগ্রহণের মধ্যেই আটকে আছে প্রকল্প । নতুন ক্যাম্পাসের কাজ কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন কবে পূর্ণাঙ্গ ও আধুনিক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দৃশ্যমান হবে ?

ইতিহাস থেকে জানা যায়, তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র, শিক্ষক ও বই নিয়েই ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে সময় জগন্নাথ কলেজের অনার্সের প্রায় ৩১৩ জন শিক্ষার্থী, বেশিরভাগ শিক্ষক ও মূল্যবান বই হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমনকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকটের কথা চিন্তা করে পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তখনই ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। তাই, জগন্নাথ কলেজের অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১টি হলের নামকরণ করা হলো জগন্নাথ হল ।

নানা সংকট সত্ত্বেও উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি দেশ বিদেশে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নজরকাড়া সাফল্য অনেকের জন্য রোল মডেল । শিক্ষার পাশাপাশি ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি ন্যায্য আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশীদার প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সেমিস্টার সিস্টেমে পড়াশোনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নেই বললেই চলে। পরিবহন সংকট ও একমাত্র বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল ব্যতীত একদমই অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে শিক্ষক শিক্ষার্থী সবার মহামূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে ।

শিশুর কৈশর থেকে যৌবনে পদার্পণের মত সম্ভাবনার আঠারো বছরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। ‘ এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’ কবি হেলাল হাফিজের কবিতার মত ঠিক তেমনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মিছিল হোক সকল অপূর্ণতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। আর যুদ্ধ হোক বৈশ্বিক প্রতিযোগীতায় প্রযুক্তিনির্ভর মেধাবীভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দেওয়ার। তাই জবি’র সকল মেধাবীর মুখে উচ্চারিত হোক ‘ আমি তোমাকে গর্বিত করবো বলে তোমাকে নিয়ে গর্ব করি না ‘।

অনেক অপর্যাপ্ততা, সংকট ও শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ইউজিসির এ-গ্রেড ভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করেছে অত্র প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়া দেশের ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ ধরনের বারকোড পদ্ধতি চালু করাও ছিলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ । ইতোমধ্যে, বিভিন্ন প্রতিযোগিতাতামূলক চাকুরী পরীক্ষায় অন্যদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে থাকলেও গবেষণায় এখনো আশানুরূপ সাফল্য না আসায় শিক্ষাবিদরা হতাশ। যদিও সম্প্রতি দেশসেরা বিভাগ হয়েছে জবির রসায়ন বিভাগ। অধিকন্তু, প্রজেক্ট প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়াসহ তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় মেধার সাক্ষর রেখে চলেছে জবির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ। উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৫তম বছরে এসে ২০২০ সালের ১১ই জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে ১৮ হাজার ২৮৪ জন শিক্ষার্থী অংশ নেওয়ায় বিশ্ব ইতিহাসে নজির সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তাই না, দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায়ও নেতৃত্ব দিচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তাই সুকান্তের ভাষায় ‘ আঠারো বছর বয়সে নেই ভয়, এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয় ‘।

ঐতিহ্যের ক্যাম্পাসের প্রবেশ করে প্রথমেই আপনার চোখে পড়বে ভাস্কর রাশার নির্মিত দেশের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের গুচ্ছ ভাস্কর্য। যার এক পাশে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব আর অপর পাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র। এর পর সামনে এগোলেই দৃষ্টিগোচর হবে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার ও প্রধান প্রশাসনিক ভবন। এর উত্তর দিকে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক চর্চার প্রধান কেন্দ্র অবকাশ ভবন। আর দক্ষিণ দিকে আছে ভাষাশহীদ রফিক ভবন। সর্ব পশ্চিমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের মাঠ যা ছিলো মূলত ৭১ এ বধ্যভূমি এবং সর্ব উত্তরের মানবিক অনুষদের খোলা জায়গাই হলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মূল কেন্দ্রস্থল । পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে বর্ণিল সাজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর আলোচনায় সমবেত হোক প্রাণ, জাগুক স্পন্দন— সাফল্য ও সম্ভাবনার।

কালের বিবর্তনে সাফল্য ও সম্ভাবনা নিয়ে আঠারোতে পদার্পণ করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্যের আতুরঘর হিসাবে নানা অপর্যাপ্ততা ও সীমাহীন সংকটের মধ্যেও খুব অল্প সময়ে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে নিজস্ব স্বকীয়তায় এগিয়ে যাচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় । তাই কবির ভাষায় ‘ তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি, জগন্নাথের বুকে আঠারো আসুক নেমে ‘

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট
সভাপতি- কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল- fokoruddincse@gmail.com

জবি