৭৮০ কোটির এই পৃথিবীর মানুষের উন্নয়নে প্রয়োজন টেকসই ব্যাবস্থাপনা। পরিবেশ ও উন্নয়নমূলক সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের লক্ষে ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম জাতিসংঘ বিশ্বের সবগুলো স্বাধীন দেশকে (১৯৩) একত্রিত করে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে মোট ১৭ টি লক্ষ্য নিয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। টেকসই উন্নয়ন হলো এমন উন্নয়ন যা বর্তমান প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সে সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা পূরনের ক্ষেত্রে আপোষ বা বাঁধার কোন কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সে দিকে লক্ষ্য রেখে পরিকল্পিত উন্নয়ন।
এখন প্রশ্ন হলো জীবপ্রযুক্তি কি ? আর এই লক্ষ্যগুলো অর্জনে জীবপ্রযুক্তি কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে ?
জীবপ্রযুক্তি হলো বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে জীবদের ব্যাবহার করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাকর ও ব্যাবহারযোগ্য প্রয়োজনীয় পন্য ,সেবা তৈরির বিশেষ প্রযুক্তি।
জীবপ্রযুক্তি ব্যাবহারের মাধ্যমে SDG(Sustainable Developmentak Goal )এর লক্ষ্যগুলো আরো সহজভাবে অর্জন করা সক্ষম হবে। আর এই ১৭ টি লক্ষ্যের ১১ টি অর্জনে জীবপ্রযুক্তি প্রত্যক্ষভাবে আর ৬টি পরোক্ষভাবে জড়িত। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
১। একজন মানুষও যেন পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত না থাকে।
– লক্ষ্যঃ ২
জিন প্রকৌশল ব্যাবহার করে ফসলের উৎপাদন এবং পুষ্টিগুণ বাড়িয়ে বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করতে পারি যেমনঃ টেকসই কৃষি ব্যাবস্থাপনার জন্য CRISPER, মাইক্রোবায়োম থেরাপি, এছাড়াও খাদ্যে ক্ষতিকর ও ভেজাল সনাক্ত করার জন্য ( পিসিআর, লিটমাস পেপার) ইত্যাদি ব্যাবহার হয় যা সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করে।
২। সকল বয়সের মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করন।
-লক্ষ্যঃ৩
পৃথিবীর মোট ওষধের ৬৯ শতাংশই জীব প্রযুক্তি ব্যাবহার করে তৈরি করা হয়, ৩৫ কোটি মানুষ জীবপ্রযুক্তির থেরাপি ব্যাবহার করে থাকে , অ্যালঝাইমার ও ক্যান্সারের মতো ব্যাধির বিরুধে লড়াই করার জন্য জীবপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে “বায়োড্রাগ ” তৈরি করা হচ্ছে এবং প্রানঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের ফলে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে ,মানুষ আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে। এছাড়াও – ব্যক্তি বিশেষ ওষধ ,কোষ থেরাপি,জিন থেরাপি ,টিস্যু থেরাপি ইত্যাদি চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জনে আরোও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে জীবপ্রযুক্তি।
৩। নারী পুরুষ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন।
-লক্ষ্যঃ ৫
জীবপ্রযুক্তি বিভাগে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা ও উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে , জীবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান R&D এর ৬০ শতাংশই নারী কর্মী, ২৪.৪ শতাংশ কার্যনির্বাহী হলের সদস্য, অর্থাৎ জীবপ্রযুক্তি নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরন এর পাশাপাশি বেকারত্বও দূরীকরণে সহায়তা করছে,ফলে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌছানর পথও সুগম করে তুলছে জীবপ্রযুক্তি।
৪। সকলের জন্য বিশুদ্ধ পানি ও স্বাস্থ্য- সেবার টেকসই ব্যাবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ।
-লক্ষ্যঃ৬
পানি মানুষের জীবনের অপরিহার্য উপাদান, জীবপ্রযুক্তি ব্যাবহারে তৈরি করা শস্য কম পানি শোষণ করে এবং সেই সাথে ভালো ফলন নিশ্চিত করে (PsbS প্রোটিন যা ব্যাবহারের ফলে উদ্ভিদের ২৫% পর্যন্ত পানি শোষণ হ্রাস পেয়েছে ) যেমনঃ মটর,ভুট্টা, সয়াবিন ইত্তাদি। পানি বিশুদ্ধ করনে এবং পানি থেকে ক্ষতিকর রাসায়ানিক দূর করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুজীব ( Pseudomonas aeruginosa , Flavobacterium, and Acinectobacte) সহ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি পরিষ্কারে এনজাইমিক ডিটারজেন্ট ব্যাবহার করা হয়, জিন এডিটিং বা সংযোজনের মাধ্যমে খরা সহনশীল ফসলও উৎপাদন হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। উল্লেখ্য ; স্পেনে গত ২০ বছরে ভুট্টা চাষাবাদের দরুন ১০৪২ কিউবিক মিটার পানি সংরক্ষন হয়েছে।)
৫। সাশ্রয়ী মূল্যে নির্ভরযোগ্য ও টেকসই আধুনিক শক্তি নিশ্চিতকরণ।
– লক্ষ্যঃ৭
জীবপ্রযুক্তি শক্তি উৎপাদনে আরও দক্ষ বিকল্প পন্থাগুলো সরবরাহ করে সেই সাথে শহর ,বন এবং কৃষি থেকে উৎপাদিত বর্জ্য (বায়োমাস) যা বিদ্যুৎ উৎপাদন সহ পরিবেশকেও দূষনমুক্ত রাখে ( নবায়নযোগ্য শক্তি) যেমনঃ প্রতি ১০০ পাউন্ড কঠিন বর্জ্য থেকে ৮৫ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়; আমেরিকা ) যাতে করে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যাবহার বাড়ছে এবং অনবায়নযোগ্য শক্তির অপচয়ও হ্রাস পাচ্ছে।
৬। স্থিতিস্থাপক অবকাঠামো তৈরি এবং টেকসই শিল্পায়ন উদ্ভাবন ও লালন।
– লক্ষ্যঃ৯
জীবপ্রযুক্তির প্রতিটি কার্যক্রম উদ্ভাবনের সাথে জড়িত আর প্রতিবছর জীবপ্রযুক্তিগত প্রতিষ্ঠান বেড়েই চলেছে । এই প্রতিষ্ঠানগুলোর গড় বার্ষিক আয় ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী (Johnson & Johnson, Roche,Merck & Co.) যা দেশের উন্নতি সাধনের পাশাপাশি বৈশ্বিক উন্নয়নও নিশ্চিত করে ফলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্জনে জীবপ্রযুক্তি আরও অগ্রসর হয়।
৭। সঠিক ব্যায় ও টেকসই উৎপাদন নিশ্চিতকরণ।
-লক্ষ্যঃ১২
জৈব উপাদানগুলো পুনঃব্যাবহারের উপযোগী করে তৈরি পুনঃব্যাবহার , সার হিসেবে কাজে লাগানো ,শক্তিতে রুপান্তর , এভাবে চক্রাকার ব্যাবহার অর্থনীতিতে অবদান রাখে( বায়োপ্লাস্টিক , ফাংশনাল ফুড, প্রাকৃতিক প্রসাধনী ইত্যাদি) ।
৮। জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবেলায় জরুরী পদক্ষেপ গ্রহন
-লক্ষ্যঃ ১৩
জীবপ্রযুক্তি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমিত করতে সাহায্য করে উদাহরণস্বরূপঃ জীবপ্রযুক্তি ভিত্তিক পন্য ( জৈবপ্লাস্টিক- স্টার্চ ,সেলুলোজ,অ্যালিফ্যাটিক পলিয়েস্টার। জৈবসার- Bacillus thuriengeinsis, পাইরেথ্রিন)। উল্লেখ্য যে জৈবপ্রযুক্তির পন্যগুলো শতকরা ৬৫ শতাংশ গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস করে পরিবেশকে দূষণ মুক্ত রাখে।
৯। সমুদ্র সংরক্ষণ এবং ব্যাবহারের জন্য সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই উন্নয়ন।
– লক্ষ্যঃ১৪
সামুদ্রিক প্রাণীর আবাসস্থল সংরক্ষণে এবং প্রাণীর বসবাসের উপযোগী করতে ক্ষুদ্রশৈবাল , অনুজীব , ( Chlorella, Actinomyces Bifidobacterium ) ইত্যাদি ব্যাবহার করা হয়। বায়োরেমিডিয়েশন এবং প্লাস্টিক ভক্ষকারী ব্যাকটেরিয়া Ideonella sakaiensis ব্যাবহারের ফলে সামুদ্রিক মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।
১০। বন ব্যাবস্থাপনা বৃক্ষ নিধন,ভূমিধ্বস, জীববৈচিত্রের ক্ষতি প্রতিরোধ করা।
-লক্ষ্যঃ১৫
ISAAA এর তথ্য মতে ২৩ কোটি ১০ লক্ষ হেক্টর জমি সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে জীব প্রযুক্তিগত ফসল চাষে যা মাটির ক্ষয়রোধ করে। আর এর ফলে পরিবেশের উপর ক্ষতির প্রভাব কমেছে ১৮.৪ শতাংশ আর ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা এবং মানুষের মৌলিক অধিকারহানী কমছে, যা বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস।
১১। টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাপী পরস্পর সম্পর্ক উন্নয়ন ও শক্তিশালীকরণ।
-লক্ষ্যঃ১৭
বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেও জীবপ্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যেমনঃ করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে বিশ্বের সকল জীব প্রযুক্তিবিদগণ একজোট হয়ে সকল মানুকে সেবা দিয়েছে যার ফলস্বরূপ মানুষ মুক্তি পেয়েছে এই প্রানঘাতী ভাইরাস থেকে ।
জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে এই ১১ টি লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব আর এই ১১ টি লক্ষ্য অর্জন করার সাথে সাথে পরোক্ষ ভাবে বাকি ৬ টিও কাঙ্ক্ষিতভাবে অর্জন সম্ভব হবে । এই ১৭ টি লক্ষ্যকে আমরা মোট ৩ ভাগে ভাগ করতে পারিঃ পরিবেশ বিষয়ক ,সামাজিক এবং অর্থনৈতিক। যার মধ্যে পরিবেশ হলো সবকিছুর মূলভিত্তি , যদি আমরা এই ৩ টিকে একটি তিন স্তর বিশিষ্ট কেকের সাথে তুলনা করি তাহলে দেখা যাবে যে সবচেয়ে নিচের স্তরটি হলো পরিবেশ যার উপর বাকি দুইটি স্তর নির্ভর করছে আর কেক তৈরির উপাদান হলো জীবপ্রযুক্তি । পরিবেশের উন্নয়ন হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত আর পরিবেশ দূষিত হয় তাহলে আর্থসামাজিক উন্নয়ন প্রায় অসম্ভব আর পরিবেশের উন্নয়নে জীবপ্রযুক্তির জুড়িমেলা ভার।
উপরক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে জীবপ্রযুক্তির ভুমিকা প্রতীয়মান।
তথ্যসুত্রঃ-
লেখকঃ
মাইমুন নাহার মুন্না,
তৃতীয় বর্ষ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়