প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় আগের চেয়ে বেশি মানুষ ঋণ নিয়েছেন। এর প্রভাব পড়েছে ভোক্তাঋণে।সংসারের খরচ বাড়েনি—দেশে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই বাড়তি খরচ মেটাতে না পেরে অনেকে এখন বাজারতালিকা ছোট করে এনেছেন। এতে বহু পণ্য ঝরে পড়ছে তালিকা থেকে।
আবার সংসার খরচ বাড়লেও অনেকেই তালিকা ছোট করতে পারেননি। সামাজিক মর্যাদা ধরে রাখার জন্য তাঁরা ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন।সংসারে ব্যয়ের খতিয়ান তুলে ধরে বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবীরা খাবারের ব্যয় কমিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না। মানুষ তো কোনো না কোনোভাবে বেঁচে থাকবে।‘আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা নেই। এতে প্রভাব পড়েছে ব্যাংকগুলোর দেওয়া ভোক্তাঋণে।
আরও পড়ুন…মধুপুর প্রেসক্লাব গ্রন্থাগারে পিআইবি’র বই হস্তান্তর
সদ্যবিদায়ী ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাস জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ভোক্তাঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এই সময়ে গাড়ি কেনার ঋণ অবশ্য কমেছে। তবে ফ্ল্যাট বা গৃহঋণ বিতরণও বেড়েছে মাত্র ৬৭২ কোটি টাকা। তাহলে ভোক্তাঋণ গেল কই? আসলে এই ঋণের সিংহভাগই গ্রাহকেরা নগদে উত্তোলন করেছেন। ২০২১ সালের পুরো সময়ে ভোক্তাঋণ বেড়েছিল ১৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের খাতভিত্তিক ঋণের চিত্র পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত বছরে ব্যক্তিগত ঋণে আমাদের ১৫-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। অন্য সময়ের চেয়ে ব্যক্তিগত ঋণের চাহিদাও বেশি ছিল। সুদহার এখনো আগের মতো ৯ শতাংশ রয়েছে।
অরুপ হায়দার প্রধান, ভোক্তাঋণ বিভাগ, সিটি ব্যাংক।
ব্যাংকাররা বলছেন, বিদায়ী বছরে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়লেও ব্যাংক ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। চাকরিজীবীদের ছোট অঙ্কের ব্যক্তিগত ঋণ পেতে তেমন ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। যাঁদের ব্যাংকে আগে থেকেই স্থায়ী ও মেয়াদি আমানত ছিল, তাঁদের জন্য ঋণ পাওয়া ছিল আরও সহজ। ক্রেডিট কার্ডেও খরচ বাড়িয়েছেন ভোক্তারা।
দেশে ভোক্তাঋণ বিতরণে শীর্ষ ব্যাংকগুলোর একটি ব্র্যাক ব্যাংক। গত বছর ব্যাংকটির ভোক্তাঋণের স্থিতি সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এই ব্যাংকের ভোক্তাঋণ বিভাগের প্রধান মাহিয়ুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, গত বছরে ভোক্তাঋণে তাঁদের প্রায় ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ক্রেডিট কার্ডের ঋণ ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। চলতি বছরে ঋণের চাহিদা আরও বাড়বে।
আরও পড়ুন…মেসি এই বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়
জানা যায়, ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকগুলোর ভোক্তাঋণের স্থিতি ছিল ৯৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের পুরো সময়ে ভোক্তাঋণ যেখানে বেড়েছিল ১৪ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা, সেখানে ২০২২ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর—৯ মাসেই বেড়েছে ১৭ হাজার ৯৫ কোটি টাকা।
দেশের ব্যাংকগুলোর ভোক্তাঋণের বেশির ভাগই যায় জমি, ফ্ল্যাট ও গাড়ি ক্রয়, ক্রেডিট কার্ড, পেশাজীবী ঋণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয়, বিবাহ ও ভ্রমণ খাতে। এ ছাড়া বেতন ও আমানতের বিপরীতেও ঋণ নেন অনেকে। ভোক্তা খাতের ১ লাখ ১২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ফ্ল্যাট কেনায় ১৯ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা, গাড়ি ক্রয়ে ৩ হাজার ২২৯ কোটা টাকা, ক্রেডিট কার্ডে ৭ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।
অন্য খাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ গেছে টেলিভিশন, ফ্রিজ, এয়ারকুলার, কম্পিউটার ও ফার্নিচার কেনার জন্য। এগুলোর জন্য ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়েছে ৫ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকা। বাকি ঋণের পুরোটাই নগদে উত্তোলন করা হয়েছে। ফলে ঋণের বড় অংশ ব্যবহৃত হয়েছে সংসার খরচে বা অন্য কাজে। একই সময়ে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ভোক্তাঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। বেতনের বিপরীতে ঋণ বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। শীর্ষস্থানীয় ভোক্তা ঋণদাতা সিটি ব্যাংক গত বছরে গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ ভোক্তা ঋণ দিয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
বেসরকারি ব্যাংকটির ভোক্তাঋণ বিভাগের প্রধান অরুপ হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরে ব্যক্তিগত ঋণে আমাদের ১৫-২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। প্রায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। অন্য সময়ের চেয়ে ব্যক্তিগত ঋণের চাহিদাও বেশি ছিল। সুদহার এখনো আগের মতো ৯ শতাংশ রয়েছে।’
গত বছরে ব্যাংকগুলো ভোক্তাঋণে ভালো ব্যবসা করলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো করতে পারেনি। এর কারণ জানতে চাইলে লংকাবাংলা ফাইন্যান্সের ভোক্তাঋণ বিভাগের প্রধান খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোক্তাঋণের অনেক গ্রাহক কম সুদের কারণে কয়েকটি ব্যাংকে চলে গেছে। এর ফলে ব্যক্তিগত ঋণে আমাদের প্রবৃদ্ধি ভালো হয়নি। তবে গাড়ি ও ক্রেডিট কার্ডে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।’
আরও পড়ুন…শেখ হাসিনার আমলেই প্রবৃদ্ধি-উন্নয়নে রেকর্ড বাংলাদেশের’
ব্যাংকাররা বলছেন, ঋণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হলো করোনার কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালের বড় সময় ঋণ পরিশোধ না করেও খেলাপি থেকে বিরত থাকার সুযোগ ছিল। ক্রেডিট কার্ডে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ঋণ ছিল ৬ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।
ইবাংলা/জেএন/৫ জানুয়ারি, ২০২৩