শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় শিশু ও বয়স্করা ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। কয়েকদিন ধরেই সারাদেশে বিরাজ করছে হাড় কাঁপানো শীত। হঠাৎ অস্বাভাবিক শীতে ছেদ পড়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায়। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা। একই সঙ্গে বেড়েছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ।
শীতে রোগের প্রকোপ বাড়লেও তা শুরু হয়েছে শীত আসার আগেই। সারাদেশে গত ১৪ নভেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩ লাখ ৭২ হাজার ৮০০ জন ঠান্ডাজনিত রোগ এআরআই বা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ এবং ডায়রিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭ হাজার ৯৮২ জন। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ২৪ হাজার ৮১৮ জন।
আরও পড়ুন…ম্যুরালে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আর কারও ছবি নয়
সারাদেশের মতো ঢাকায়ও তীব্র শীত বিরাজ করছে। ঢাকার বাসিন্দাদের গত কয়েক বছরের মধ্যে এমন অবস্থায় পড়তে হয়নি। এ অবস্থায় হাসপাতালে বেড়েছে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগী। গত ১১ নভেম্বর থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিভাগেই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়েছেন ১১ হাজার ৫৪ জন। এই সময়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২ লাখ ২৮ হাজার ৩৪৩ জন।
এই সময়ের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ২২ হাজার ৫২৮ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন ২০ হাজার ৮৪৪ জন। অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬৮৪ জন।
জানা গেছে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন ২০ জন। গত ডিসেম্বরে সেখানে নিউমোনিয়া নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ৪৩৩ জন। চলতি জানুয়ারির প্রথম ৮ দিনেই নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০২ জন। এছাড়া আউটডোর ও জরুরি বিভাগে নিউমোনিয়ার সেবা দেওয়া হয়েছে ৫১ জনকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
মুক্তামণি, বয়স ৫ মাস। ঢাকা শিশু হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে রংপুরের এই শিশুকে। সঙ্গে আছেন তার মা আঁখিমণি।
আঁখিমণি জানান, গত নভেম্বর থেকে তার (মুক্তামণি) শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। শীত আসায় এই সমস্যা আরও বেড়েছে। নিউমোনিয়ার সমস্যা নিয়ে গত সপ্তাহে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এক সপ্তাহ চিকিৎসার পর কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পরিপূর্ণ সুস্থ হয়নি।
আরও পড়ুন…বিকাশ-বিজ্ঞানচিন্তা’র আয়োজনে ‘বিজ্ঞান উৎসব’
এই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে ১০ মাস বয়সী আমিনুল ইসলামকে। বরিশাল শের-এ-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ফরিদপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। উপায়ন্তর না দেখে অবশেষে তাকে আনা হয়েছে ঢাকায়।
আমিনুলের মা ফাতিমা বলেন, ‘বরিশালে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচদিন থাকার পর ছাড়পত্র দেওয়া হয়। হাপসাতাল ছাড়ার পর আবারও সমস্যা বেড়ে যায়। আবার সেখানে নিয়ে যাই। এরপর কোনো সমাধান না হওয়ায় ফরিদপুর যাই। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিকিৎসকের পরামর্শে এখানে আসি। এখন অনেকটা সুস্থ।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সাদনানকে। তার বয়স ৭ মাস ৪ দিন। সাদনানের মা বৃষ্টি বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই নিউমোনিয়ায় ভুগছে সাদনান। শীতের তীব্রতা বাড়ার পর থেকে তার শ্বাসকষ্ট, কাশি বাড়তে থাকে। বুকে জমে থাকা কফের আওয়াজও হচ্ছিল। গত ৭ ডিসেম্বর তাকে ভর্তি করা হয়। ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তার চিকিৎসা চলে। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চলে গেলেও এক সপ্তাহ পর ফলোআপ চিকিৎসার জন্য এলে আবারও ভর্তি করার পরামর্শ দেন চিকিৎসক।’
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে শিশুদের নিউমোনিয়া চিকিৎসায় আলাদা একটি ওয়ার্ড করা হয়েছে। সপ্তম তলার একটি বড় কক্ষকে ওয়ার্ডে রূপান্তর করা হয়েছে। গত নভেম্বর মাস থেকে সেখানে শিশুদের নিউমোনিয়ার চিকিৎসা চলছে। চালুর পর থেকে কখনো কোনো বেড খালি থাকেনি সেখানে।
সেখানে দায়িত্বরত স্টাফ নার্স রোকসানা বলেন, ‘এই ওয়ার্ড চালুর কিছুদিন পর থেকেই মূলত শীত শুরু হয়েছে। এখানে সারাদেশ থেকেই রোগী আসে। তাই সবসময় সিট পূর্ণ থাকে। একজন গেলে আরেকজন আসে। এখানে আসন খালি না থাকলে অন্য ওয়ার্ডে দেওয়া হয়।’
আরও পড়ুন…সম্পত্তি ক্রোকের আদেশে উদ্বেগ জানিয়ে সংবাদ বিবৃতি ইবি জিয়া পরিষদের
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘শৈত্যপ্রবাহের কারণে অনেক রোগী বেড়েছে। বিশেষ করে টন্সিলাইটিস, ফেরেনজাইটিস, রাইনাইটিস, ব্রঙ্কোলাইটিস, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে হঠাৎ করে কিছুটা বেড়েছে। এর কারণ হলো বাংলাদেশে তো শীতটা এভাবে আসে না। শীত আসার পরে ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। এক সপ্তাহ আগেও তাপমাত্রা সেভাবে কম ছিল না। হঠাৎ করে পুরো দেশে তাপমাত্রা অনেক কমে গেছে, যে কারণে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া শ্বাসতন্ত্র ও শীতজনিত ডায়রিয়াও কিছুটা বেড়েছে।’
এ সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিশুদের যেন ঠান্ডা না লাগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুদের শীতের কাপড় ঠিকমতো পরাতে হবে, মাথা ঢেকে দিতে হবে। জরুরি কারণ ছাড়া তাদের বাসা থেকে বের করা যাবে না। নরমাল ঠান্ডা, কাশিতে শিশুদের নাক পরিষ্কার রাখতে হবে। শীতের কাপড় দীর্ঘদিন ধরে তুলে রাখা হলে তা বের করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। শিশুদের শাকসবজিজাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘খেয়াল রাখতে হবে শিশুদের ঠান্ডা, কাশি বুকে বসে যাচ্ছে কি না, শ্বাস-প্রশ্বাসের নরমাল গতি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হচ্ছে কি না, খেতে পারছে কি না, যা খাচ্ছে তা বমি করে দিচ্ছে কি না। এসব উপসর্গ দেখলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। বাসার ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা যেন ভালো থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ঠান্ডাপানিতে গোসল না করিয়ে তাদের কুসুম গরম পানিতে গোসল করাতে হবে।’
আরও পড়ুন…সপ্তম মেধাতালিকার ভর্তি শেষেও ইবিতে আসন ফাঁকা ৩৫ শতাংশ
অনেক সময় শিশুদের কিছু হলেই অভিভাবকরা ফার্মেসি থেকে এন্টিবায়োটিক কিনে খাওয়ান। এতে উপকারের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি বলে জানান তিনি। এই প্রবণতা থেকে সবাইকে বের হয়ে এসে চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুদের চিকিৎসা করাতে হবে, তাহলেই শিশুদের সুরক্ষিত রাখা যাবে বলে জানান ডা. কামরুজ্জামান।
ইবাংলা/জেএন/৮ জানুয়ারি, ২০২৩