বাবা, সন্তানদের কাছে নির্ভরতার প্রতীক। বাবা শব্দের মাঝেই জড়িয়ে আছে ভালোবাসা, মায়া, নির্ভরতা। বাবা তার ভালোবাসা, ত্যাগ দিয়ে সন্তানের কাছে হয়ে ওঠেন ‘সুপার হিউম্যান’। তাই পৃথিবীর সকল বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় ‘বিশ্ব বাবা দিবস’।
“বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর/ পুত্র তাঁহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর!/ চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার।/…মরিল বাবর– না, না ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে কয়?/ মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়,/ পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়!”
সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার হৃদয়স্পর্শী চিত্র ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায় তুলে ধরেছেন গোলাম মোস্তফা। যেখানে সন্তানের রোগমুক্তির আশায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেন বাবা। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর সন্তানের প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য উদাহরণ হয়ে আছেন। একজন বাবা সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করেন। বাবা দিবসের ইতিহাস বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে বাবা দিবস পালনের প্রচলন হয়। মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল- এটা বোঝানোর জন্যই এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর সব বাবাদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশের ইচ্ছা থেকেই যার শুরু।
১৯০৭ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার মোনোনগাহ্য় কয়লা খনিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারান ৩৬২ জন পুরুষ। নিহতদের বেশির ভাগই ছিলেন সন্তানের বাবা। এই ঘটনায় প্রায় এক হাজার শিশু পিতৃহারা হয়ে পড়ে। এই ঘটনায় ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই পশ্চিম ভার্জিনিয়ার এক গির্জায় একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। নিহতদের সম্মান জানাতে সন্তানরা মিলে এই প্রার্থনাসভার আয়োজন করে। এটি ছিল বাবাকে সম্মান জানাতে ইতিহাসের প্রথম আয়োজন। সোনোরা স্মার্ট ডড নামে এক নারীর বড় ভূমিকা রয়েছে বাবা দিবসকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে।
১৯০৯ সালের আগে ওয়াশিংটনে বাবা দিবস বলে কোনো বিশেষ দিন ছিল না। সে সময় স্থানীয় গির্জায় ডড মা দিবস পালনের কথা শোনেন। মা দিবস পালনের রীতি রয়েছে কিন্তু বাবা দিবস পালনের রীতি নেই জেনে ডড ভীষণ অবাক হন। তারপর তিনি বাবা দিবসের স্বীকৃতির জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ডড তার বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। মা ছিল না তার। মায়ের মৃত্যুর পর শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে থেকেও তাদের সাত ভাইবোনকে বড় করে তুলেছিলেন তাদের সিঙ্গেল বাবা। বাবার এই ত্যাগ দেখে ডডের মনে হলো, মা দিবসের এত আয়োজন হলে বাবা দিবস কেন বাদ থাকবে। বাবাকে সম্মান জানানোর জন্যও একটা দিন থাকা দরকার। তারপর দীর্ঘ এক বছরের চেষ্টায় স্থানীয় কমিউনিটিগুলোতে বাবা দিবস পালন করতে পারেন ডড। ১৯১০ সালের ১৯ জুন বিশ্বে প্রথমবারের মতো পালিত হয় বাবা দিবস। ওয়াশিংটন থেকে শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এ দিবস পালনের কথা। মা দিবসের পাশাপাশি বাবা দিবসের প্রতিও সচেতন হতে থাকেন সন্তানরা। এরপর ১৯২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলি বাবা দিবসে সম্মতি দেন। তারপর ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন জুন মাসের তৃতীয় রবিবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস উদযাপনের কথা ঘোষণা করেন। এবং সবশেষে ১৯৭২ সালে তখনকার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন একটি আইনে স্বাক্ষর করে বাবা দিবসকে জাতীয় মর্যাদা দেন। তারপর থেকে জুন মাসের তৃতীয় রবিবার সারা বিশ্বে বাবা দিবস পালন হয়ে আসছে।
কোন দেশে কবে পালিত হয় বাবা দিবস
সাধারণত প্রতি বছর জুনের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছর আজ রোববার (১৮ জুন) বাবা দিবস। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এই হিসেব অনুযায়ী দিবসটি পালন করে থাকে। তবে কয়েকটি দেশ ভিন্ন মাসে এবং ভিন্ন তারিখে বাবা দিবস পালন করে। যেমন— দক্ষিণ আমেরিকায় দিবসটি পালিত হয় ১৯ মার্চ। আর অস্ট্রেলিয়া ও ফিজিতে পালন করা হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রোববার।
যেভাবে পালিত হয় বাবা দিবস
বাবা দিবস পালনের ক্ষেত্রে দেশভেদে বৈচিত্র্য দেখা যায়। এ দিবসটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। এ দিন ছেলেমেয়েরা তাদের বাবাকে উপহার দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে। আর বাবারাও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে গিফট পেয়ে বেশ অভিভূত হয়ে যান। এ গিফট দেয়ার ক্ষেত্রেও দেশ ভেদে দেখা যায় ভিন্নতা। কোনো কোনো দেশে ছেলেমেয়েরা বাবাকে কার্ড বা ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানায়। আবার কোথাও কোথাও বাবাকে ছেলেমেয়েরা নেকটাই ও উপহার দেয়। অনেকে আবার বাবা দিবস উপলক্ষে কেক কাটার আয়োজনও করে। একটি পরিবারে মায়ের চেয়ে বাবার গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়। পরিবারের প্রধানের ভূমিকায় বাবার অবদান অনস্বীকার্য। বাবার কঠোর শাসন অনেকের জীবনের গতিকে পরিবর্তন করে আলোর পথে এনেছে। বাবা সন্তানের জন্য এক বটবৃক্ষ। পৃথিবীর সব বাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে কবির ভাষায়, ‘বাবা’ কখনো বলা হয়নি তোমায় ঠিক কতখানি ভালোবাসি।
ইবাংলা/এসআরএস