অপরাধ জগতের সম্রাট মোহাম্মদ জাহান কবির ওরপে শিপন ছেলেবেলা থেকে দুষ্ট প্রকৃতির ও ডানপিঠে ছিল। বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো শিপনের জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুনবতীর খাটরা গ্রামে। বাবা আবদুল কাদের ছিলেন স্কুল শিক্ষক। শিপন বর্তমানে যুক্তরাজ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে বিলাসী জীবন যাপন করছে।
আরও পড়ুন…গোয়েন্দা নজরদারিতে এমটিএফই’র ৪০০ সিইও মামলা হলেই গ্রেফতার
ছেলেবেলা থেকে মানুষের ক্ষেতের ফলফলাদি ও গৃহপালিত হাঁস মুরগী চুরিসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারণে গ্রাম্য শালিশে জরিমাণাসহ বার বার সতর্ক করা হয় বলে গ্রামবাসী জানায়। কিন্তু চোরে শুনেনা ধর্মের কাহিনী। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করার পরও তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় নি। ক্রমান্বয়ে তার অপরাধের মাত্রা বেড়ে যায় এবং গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।
গ্রামের মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য প্রতারণার নানা ছলচাতুরী আবিস্কার করে। নীতি ও নৈতিকতা হারিয়ে মাস্টারের ছেলে শিপন দিনের দিন অপরাধের সিংহ পুরুষ বনে যায়। বড় হওয়ার সাথে সাথে তার অর্থবৃত্তের প্রতি লোভ বেড়ে যায়। ফলে লেখাপড়ায় অমনোযোগী হয়ে উঠে।
স্টুডেন্ট ভিসা, জব ভিসা দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা এলাকার নিরীহ লোকজন থেকে হাতিয়ে নেয়। মাস্টারের ছেলে হিসাবে সবাই তাকে বিশ্বাস করে এবং তাদের ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠানোর জন্য লাখ লাখ টাকা তার হাতে তুলে দেয়। শিপন স্টুডেন্ট ভিসা বা জব ভিসার নামে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে মানুষকে বিদেশে পাঠায়।
নকল/ভুয়া কাগজপত্রের কারণে বিদেশে অনেকে আটকা পড়ে যায় এবং জেলে যেতে হয়। আবার অনেকে বিদেশের মাটিতে ভিক্ষা বৃত্তি করে জীবন নির্বাহ করে। অবৈধ পন্থায় মানব পাচার করে মানুষের সব টাকা পয়সা নিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে বিদেশে পাড়ি জমায়। তার এ প্রতারণার জন্য গ্রামের নিরীহ লোকজন তার বিরুদ্ধে জিডি ও মামলা করে।
আরও পড়ুন…মোবাইল ক্যাসিনোসহ কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের দু’দফা অভিযানে আটক-৭০
এলাকার গণ্যমান্য মুরুব্বীরা তাকে আইন শৃংখলার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করে। অনেক বছর পর অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে শিপন দেশে আসলে পুলিশ তার বাড়ী ঘেরাও করে হাতে নাতে ধরার চেষ্টা করে কিন্তু সে পালিয়ে ঢাকায় চলে যায় পরে বিদেশ পাড়ি দেয়। প্রতারণাও মানবপাচারের অসংখ্য ঘটনা শিপনের বিরুদ্ধে রয়েছে।
গুনবতী ইউনিয়ন ও পার্শ্ববর্তী আরো দুটি ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান এবং সাবেক কয়েকজন চেয়্যারমান, মেম্বার, স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদ ও ঈদগাহের ইমাম, কমিউনিটি পুলিশের কর্মকর্তা, স্থানীয় চিকিৎসক, উকিল এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার ব্যক্তিদের কাছ থেকে শিপনের প্রতারণা ও জাল জালিয়াতি সংক্রান্ত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। জাহান কবির শিপনের এ অপকর্মে এলাকবাসী চরমভাবে বিব্রত এবং অসন্তুষ্ট।
আরও পড়ুন…ডেঙ্গুতে মৃত্যু ৯, আক্রান্ত লাখ ছাড়ালো
উল্লেখ্য, বিগত ১৫ বছরে শিপন ২/৩ বার বাংলাদেশ আসলেও কখনও এক সপ্তাহের বেশী থাকেনি। ভুক্তভোগীদের অনেকে দেশের বিভিন্ন থানায় জাহান কবির শিপন, তার বড়বোন মঞ্জুয়ারা বেগমসহ তার পরিবারের কয়েকজনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরী করে। সম্প্রতি তার ভাই হুমায়ুন প্রতারনার মামলায় গ্রেফতার হয়েছে।
কথায় বলে চোরের মার বড় গলা। তারা এ অপবাদ থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য মানুষের পাওনা টাকা না দিয়ে নানা অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে। সূত্রমতে বাংলাদেশী পাসপোর্ট (নং EK 192086) নিয়ে দেড় দশক ধরে যুক্তরাজ্যেও লন্ডন সহ বিভিন্ন স্থানে স্বপরিবারে (স্ত্রী নাসরিন আহমেদ ও তিন সন্তানসহ) বসবাস করে।
জাহান কবির শিপন বার বার স্থান পরিবর্তন করে নানাভাবে পরিচয় দিয়ে দেশী বিদেশীদের সাথে প্রতারনার সুযোগ গ্রহণ করে। প্রথমে শিক্ষার্থী হিসাবে লন্ডনে আসেন। প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে পরিচালনা করছেন কয়েকটি রেস্টুরেন্ট একটি গ্রোসারী দোকান ও একটি কফি শপ। মুখে নিজের প্রতিষ্ঠান দাবী করলেও একটি প্রতিষ্ঠানও কাগজপত্রে নিজের নামে নেই।
আরও পড়ুন…মওদুদের স্ত্রী হাসনা মওদুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়া উচিত: কাদের মির্জা
আদালতে নিজকে নিঃস্ব সহায় সম্বলহীন ও দেউলিয়া প্রমাণ করার জন্যেই তার এ ছলচাতুরী ও প্রতারণার কৌশল। ভুয়া কাগজপত্র তৈরীতে দক্ষ ও পরিপক্ক। তথ্যমতে জাহান কবির শিপন লন্ডনের ২২ সিডার এভিনিউ এর (ব্ল্যাক ওয়াটার ক্যাম্বরলী) বাড়ীটি নিজের দাবী করলেও রেকর্ডপত্রে এটি একটি অস্থায়ী (ভাড়া) মালিকানার চুক্তি। ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসের নিয়মানুযায়ী চুক্তিটি করেছেন মিস শারমিন ফারহানা।
বাড়ীর প্রকৃত মালিক নেপালী বংশোদ্ভুত অনীল গুরুং এবং মিসেস জিনা গুরুং। জাহান কবির শিপন যে গাড়ীটি (ল্যান্ড রোভার ডিসকভারী) ব্যবহার করেন সেটি ও তার নিজের নামে নয়। জনৈক আবদুল আলিম চৌধুরী (আবদুল্লাহ) এর কাগজপত্র দিয়ে গাড়ীটি কিনেন শিপন। শিপনের নিজের নামে করা ব্যাংক একাউন্ট গুলোতে লেনদেন অত্যন্ত সীমিত।
জমার তুলনায় উত্তোলন বেশী। ব্যবহার করেন অন্যের নামে ইস্যুকৃত ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড/ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা অ্যাকাউন্ট গুলোতে লেনদেন সতর্কভাবে সীমাবদ্ধ। ক্রেডিট রেটিং অত্যন্ত কম। একারনে আইনগতভাবে নিজের নামে বাড়ী কেনা/বাড়ীভাড়া করতে পারেনা। বসবাস বা কিংবা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্য বাড়ী ভাড়া নেন অন্যের নামে।
২২ সিডার এভিনিউ, ব্ল্যাক ওয়াটার ক্যামবারলী, সারেই (পোস্টকোড GU170JF) ঠিকানাটিকে নিজের বাসা বলে দাবী করেন। এটি মূলত কুমিল্লা জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল্লাহহেল বাকীর মেয়ে ডা: শারমিন ফারহানা (চৈতি) এর নামে ভাড়া নেওয়া। জাহান কবির ভাড়া চুক্তির স্বাক্ষী মাত্র। প্রতিবেদক হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে বিষয়টি নিশ্চিত হন।
আরও পড়ুন…নোয়াখালীতে ২১ আগস্ট শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা
অন্যের সম্পদ ও প্রতিষ্ঠান কে নিজের দাবী করে নিজকে বিরাট ব্যবসায়ী জাহির করে নবাগতদের সাথে প্রতারণা করে। তার আয়ের প্রধান উৎস প্রতারণা। তার প্রতারণার কাহিনী লন্ডনের প্রবাসীদের মুখে মুখে। প্রতারণা করে প্রবাসী বাংলালাদেশীদের কাছ থেকে নগদে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার পাউন্ড। আবার হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজন ও শশুর শাশুড়ীর কাছে।
প্রতারিতরা অসংগঠিত যার ফলে শিপনের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে পারছে না। আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগও অনেকের নেই। শুধু নিজ দেশের মানুষের কাছ থেকেই নয় বিভিন্ন কায়দায় অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে ইংল্যান্ডে বসবাসরত ভারত পাকিস্তান চীন নেপাল ভেনিজুয়েলা ও রোমানিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে। শিপন এখন বিশ্ব প্রতারক।
আরও পড়ুন…তারেক রহমানের বাড়ির দরজায় টানানো হলো হাইকোর্টের নোটিশ
শিপনের কাছে অর্থ খুইয়েছেন ২০ ব্যক্তির সংগে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়েছে এ প্রতিবেদকের সংগে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশের মোর্শেদের কাছ থেকে ১২ হাজার পাউন্ড সিলেটের মামুনের কাছ থেকে ৫ হাজার পাউন্ড। জনাব কয়েসের কাছ থেকে নিয়েছে ১৫ হাজার পাউন্ড, সিলেটের বেগম জমিলার কাছ থেকে বাংলাদেশী মুদ্রার ৩৫ লক্ষ টাকা।
সিলেটের মুসলেম মিয়ার কাছ থেকে ১৬ হাজার পাউন্ড। ফেনীর সেলিমের কাছ থেকে ৫ হাজার পাউন্ড। ইংল্যান্ড প্রবাসী পিরোজপুরের জাহিদ হাসানের কাছ থেকে ১৮ হাজার পাউন্ড। চট্টগ্রামের শাহ মোহাম্মদ খান গিয়াসের কাছ থেকে নিয়েছে ৮৫ হাজার পাউন্ড। চট্টগ্রামের রাসেলের কাছ থেকে ৬২ হাজার পাউন্ড।
সৌদি প্রবাসী ফেনীর জিয়ার কাছ থেকে বাংলাদেশী মুদ্রার ২ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। ফেনীর জিয়ার বন্ধু এবং শিপনের সহপাঠি তুহিনের কাছ থেকে ৭ লক্ষ টাকা। জিয়ার আরেক বন্ধু কুমিল্লার গুনবতীর রুবেলের কাছ থেকে নিয়েছেন সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকা।
আরও পড়ুন…শ্রীলঙ্কাকে দেয়া ঋণের ৫ কোটি ডলার ফেরত পেল বাংলাদেশ
জাহান কবির শিপন যখন রেস্টুরেন্টে কাজ করতো তখন সিলেটের হামিদ নামে তার কলিগের ভাইকে ইংল্যান্ডে আনবে বলে টাকা নেয় এবং এক পাকিস্তানের পরিবারের সাথে প্রতারণা করার দায়ে স্যান্ডহার্ষ্টে (বার্কশায়ার) জাহান কিচেন নামক টেক এওয়েতে শিপনকে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য লোকজন ঘেরাও করে।
এ ছাড়া ভারতের শ্রী শ্যামের কাছ থেকে ২৫ হাজার পাউন্ড, ভারতের মিস্টার শিজুর কাছ থেকে ৩ হাজার পাউন্ড, পাকিস্তানের মিস উজালার কাছ থেকে ২০ হাজার পাউন্ড, চীনা বংশোদ্ভুত যুক্তরাজ্যের নাগরিক মিসেস উইকীর কাছ থেকে নিয়েছেন ৫০ হাজার পাউন্ড। নেপালের মিস মুকুর কাছ থেকে ৩ হাজার পাউন্ড। এভাবে দেশী বিদেশী নাগরিকদের কাছ থেকে প্রতারনার আশ্রয় নিয়ে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা ইউরোপের নানা নিয়ম কানুনের ভয়ে ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখেনা অনেকে বিশ্বাসের উপর লেনদেন করে। শিপন এ সুযোগকে কাজে লাগায়। তাকে দুর্দান্তভাবে সহযোগিতা করেন তার স্ত্রী নাসরিন আহমেদ। শিপনের অর্থ অত্মসাতের আরেকটি কৌশল হলো বাকীতে দোকানের মালামাল ক্রয় করা।
বিভিন্ন ভেন্ডরের কাছ থেকে ক্রেডিটে পণ্য কিনে পরে সেই পাওনা টাকা পরিশোধ না করে স্থান পরিবর্তন করে ফেলে। এমন কি অন্যের আইডি ও পাসপোর্ট ব্যবহার করে নেয়া ঋণ ও পরিশোধ করেনা ফলে বিপদে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় কাউন্সিল ও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা করলেও ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় কারন প্রতিষ্ঠানের কোন কাগজপত্রই নিজের নামে নয়। প্রতারনাই তার উদ্দেশ্য।
আরও পড়ুন…ইসলামী ব্যাংকের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বৃক্ষরোপণ
শিপনের বাবার ছাত্র চৌদ্দগ্রাম এর আলকরা ইউনিয়নের ডা. লকিয়ত উল্লাহ। বাবার পরিচয়ে শিপন ডা: লকিয়ত উল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং লন্ডনে চিকিৎসারত ক্যানসারে আক্রান্ত তার স্ত্রীর চিকিৎসা সেবায় স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসে যা প্রতারণার কৌশল। এ সুযোগে চিকিৎসা খরচের বিপুল অংকের টাকা শিপন ডা: লকিয়ত উল্লাহর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় এবং এক পর্যায়ে তার আসুস্থ স্ত্রীকে রুমের বাইরে তালা দিয়ে অন্যত্র চলে যায়।
তার সীমারীয় আচরণে অনেকে হতবাক এবং ক্ষুদ্ধতা প্রকাশ করে। পাওনা টাকা সে এখন পরিশোধে অস্বীকার করে নানা তালবাহানা করছে। তার প্রতারণার গল্প কাহিনীর অন্ত নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে শিপনের এ আয়েশী জীবন অনেকের কাছে চক্ষুশূল এবং পরের ধনে পোদ্দারী বলে মনে করে।
আরও পড়ুন…ঢাবির হলে শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার
লন্ডনে বসবাসরত বাংলাদেশী এবং বিদেশী নাগরিকদের কাছে শিপন বড় ধরণের পেশাদার প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত এবং আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের সাথে জড়িত আছে বলে অনেকে প্রতিবেদককে জানায়। তার এ অপরাধের জন্য দেশ-বিদেশে সকল মহলের কাছে ঘৃনিত এবং অবহেলিত। প্রতারণার স্বীকার ভুক্তভোগীরা তাকে আইন শৃংখলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টায় আছে। তবে সে এখন দেশী বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে।
চলবে…