দুবাইতে শুরু হলো জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৮

শুরু হলো জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন কপ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ)-এর ২৮তম আসর। চলবে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১৩ দিনব্যাপী এ সম্মেলনে বিশ্বের ১৯৮টি দেশের প্রায় ৭০ হাজার মানুষ অংশ নেবে।

বৃহস্পতিবার (৩০ নভেম্বর) সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের এক্সপো সিটিতে এ সম্মেলন শুরু হয়।

এ সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা পরিবেশের দূষণ কমানোসহ জলবায়ুর উন্নতির পথ খুঁজবে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ব্রিটেনের রাজা চার্লসসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস থাকবেন না৷

এবারের সম্মেলনের সভাপতি সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিল্প ও উন্নত প্রযুক্তি মন্ত্রী এবং একই সঙ্গে আবুধাবি জাতীয় তেল কোম্পানির প্রধান নিবার্হী সুলতান আহমেদ আল জাবের।

কপ ২৮-এ প্রথমবারের মতো গ্লোবাল স্টকটেক নিয়েই মূল আলোচনার হতে যাচ্ছে। যা এবারের দুবাইয়ে শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। দুই বছরের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদস্য দেশগুলো নিজেদের ক্ষেত্রে জলবায়ু সংক্রান্ত কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং সামগ্রীক কর্মকাণ্ডে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করা হয়। এর মাধ্যমে প্যারিস চুক্তির সামগ্রিক বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হলো, তা মূল্যায়ন করা যাবে।

কপ-২৮ সম্মেলনে এই স্টকটেকের সামগ্রিক পরিস্থিতি কী এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মেকাবিলায় কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে একটি রেজুলেশন নেয়া হবে। এতে রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে নতুন অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে লড়াই চলছে, তার পটভূমিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবারের মতো এবারের সম্মেলনে বেশ কিছু প্রত্যাশা থাকবে বিশ্ববাসীর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কপ-২৮ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সবাই জোরালো পদক্ষেপ নিবে এবং জলবায়ু অর্থায়ন (ক্লাইমেট ফান্ডিং) বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি স্থানান্তরের (জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে নবায়নযোগ্য উৎসের সন্ধান) বিষয়ও গুরুত্ব পাবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আসন্ন কপ-২৮ সম্মেলনে কার্যকর কোনো চুক্তির নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গমনকে ‘শূন্যে’ নামিয়ে আনার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিতে একসঙ্গে কাজ করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে ২০২৫ সালের মধ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বাতিল করে, এতে সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করা হবে।

এদিকে কপ-২৮ সম্মেলনে জলবায়ু তহবিল ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এই সম্মেলনে মোটাদাগে চারটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্ব পেতে পারে। এক, জ্বালানি ব্যবহার স্থানান্তর। দুই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে ৬০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত রুখতে কাজ করা। তিন, জলবায়ু অর্থায়ন (তহবিল) বাড়ানো। চার, জলবায়ু অভিযোজন ও স্থিতিস্থাপকতা এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া।

২০২৩ সালের জুনে প্যারিসে অনুষ্ঠিত নিউ গ্লোবাল ফাইন্যান্সিং প্যাক্টের শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়ন হিসাবে প্রাপ্তির চেয়ে তাদের ঋণ প্রদানের জন্য বেশি অর্থ প্রদানের মতো বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসে। আরও ছাড় এবং অনুদান-ভিত্তিক অর্থায়ন এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ঋণ বাতিলের জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংক ও এর সহযোগী সংস্থাগুলোর পুনর্গঠনের দাবি জানায়। এই বিষয়গুলো এবারের কপ ২৮ সম্মেলনে অবধারিতভাবে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সম্মেলনে লস অ্যান্ড ড্যামেজের বিষয়টি সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে বলে জানা গেছে। বিশেষ করে, এ সংক্রান্ত তহবিলের অগ্রগতি কী উন্নয়নশীল দেশগুলো তা জানতে চাইবে, কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অপরিবর্তনীয় ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সহায়তার জন্য উন্নত দেশগুলো এই অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এই তহবিলটি প্রতিষ্ঠার বিষয় গত বছরের মিশরের শার্ম এল-শেখ-এ অনুষ্ঠিত কপ-২৭ শীর্ষ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে একটি চু্ক্তিতে উপনীত হয়, যা একটি বিরাট সাফল্য।

তবে এই চুক্তির কার্যকারিতা নির্ভর করবে, এটি কীভাবে কাজ করে এবং এটি কত অর্থ আকর্ষণ করতে পারে তার ওপর। কপ ২৭-এ দুই বছরের মধ্যে লস অ্যান্ড ড্যামেজ তহবিল প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু এখনো এই সময়সীমা শেয় হয়নি, তাই এটি এবারের আলোচনায় মূখ্য সূচিতে নাও থাকতে পারে।

তবে সুশীল সমাজ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো এই তহবিল প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি যে আশাব্যঞ্জক নয় এবং এটি জরুরিভিত্তিতে বাস্তবায়ন করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে জোর চাপ সৃষ্ট করতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন।

অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন এবং বিশেষজ্ঞ এই নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, কপ-২৮ আয়োজন করা হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, যা জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আর তাই এই সম্মলনের ফলাফল যথেষ্ট জোরদার নাও হতে পারে। কারণ মনে রাখতে হবে যে বৈশ্বিক উঞ্চতা ২ সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার রোধ করার প্রচেষ্টাকে তীব্রতর করা উচিত।

আল-জাবের মনে করেন, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার বিষয়টি ‘অবশ্যম্ভাবী’। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তেল শিল্পকেও জড়াতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। তাই তেল ও গ্যাস উত্তোলনের সময় কার্বন নির্গমন কমাতে কোম্পানিগুলোর সহায়তা চান আল-জাবের। সে কারণে এবারের সম্মেলনে আগের যে কোনো সম্মেলনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যবসায়ী অংশ নিচ্ছেন।

এছাড়া প্রতিবাদ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ঘিরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিধিনিষেধমূলক আইন নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বজুড়ে সুশীল সমাজের নেতারা। সাধারণত জলবায়ু সম্মেলনের সময় স্বাগতিক দেশে বড় বড় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। অক্টোবরের শুরুতে যুক্তরাজ্য জাতিসংঘে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে আশ্বাস চেয়েছিল যে কীভাবে শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে সংযুক্ত আর আমিরাত মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং জমায়েত নিশ্চিত করবে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কয়লা, তেল ও গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ করা উচিত, নাকি জলবায়ুর ওপর এসব শিল্পের প্রভাব কমাতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া উচিত, তা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন রয়েছে। সম্মেলনে সেই বিভাজন আরও স্পষ্ট হতে পারে৷

এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা কমাতে বিভিন্ন দেশ যেসব অঙ্গীকার করেছে তা বাস্তবায়ন কতদূর তা নিয়েও সম্মেলনে আলোচনা হবে৷

২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার তিনগুণ বাড়াতে চায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এ লক্ষ্যে সম্মেলন চলার সময় একটি চুক্তি করতে চায় তারা। ১০০ এর বেশি দেশের পক্ষে আছে বলে বিভিন্ন দেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। তবে চীন ও ভারত এখনও পুরোপুরি এর পক্ষে সমর্থন জানায়নি।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশে খরা, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে একটি তহবিল গঠন চূড়ান্ত করার চেষ্টা করা হবে৷ ইতিমধ্যে এর খসড়া তৈরি হয়েছে৷ তবে সম্মেলনে সেটি অনুমোদন পেতে পারে৷

ইবাংলা/এসআরএস

কপ-২৮